ইয়াসার ইয়াকিস: ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে স্বাধীনতার জন্য গণভোটের কারণে যেসব দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তুরস্ক তাদের অন্যতম। কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের (কেআরজি) প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি সব সময় বলে আসছিলেন, ‘তার জনগণ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের হকদার এবং তিনি সেই লক্ষ্যে কাজ করা অব্যাহত রাখবেন।’ তাই কোনো দূরদর্শী নেতার জন্য এই গণভোট বিস্ময়কর কিছু নয়।
এ কারণে তুরস্কের নেতৃবৃন্দ গণভোটের মর্ম বা সারবস্তুর চেয়ে বরং যে সময়ে গণভোটের আয়োজন করেছে। সেই সময়ের ওপরই আলোকপাত করেছেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অবস্থায় রয়েছে। তাই এই সময়ে গণভোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করাটাকে আরো অসময়োচিত বলে বিবেচনা করা হয়েছে। দায়েশ তথা ইসলামিক স্টেটকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে, তবে তাদের এখনো পরাজিত করা যায়নি। সিরীয় সঙ্কট অবসানের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে; কিন্তু প্রধান অভিনেতারা এখনো তাদের খেলা শেষ করতে সম্মত হয়নি। বাশার আল আসাদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে প্রধান পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো চুক্তি হয়নি এবং অন্তর্বর্তীকালীন ইরাক সরকার গণতন্ত্রের পথে তার চূূড়ান্ত যাত্রা সম্পন্ন করেনি। প্রধান স্টেকহোল্ডাররা এ কারণে এবং অন্য কারণে গণভোটকে অসময়োচিত বলে মনে করেন; কিন্তু এসব কারণে বারজানি হয়তো এই পরিস্থিতিকে অধিকতর উপযোগী বলে মনে করেছেন। কেউ নিজেকে বারজানির অবস্থানে না রাখলে এই বিতর্ককে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবেন না। অন্যভাবে বলা যায়, এই সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে বারজানি বল বিরোধীদের কোর্টে নিক্ষেপ করেছেন। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়ার আগে অন্যান্য দেশ বিষয়টি নিয়ে দু’বার চিন্তা করবে। অবশ্য বারজানির সাফল্যের ব্যাপারেও কোনো গ্যারান্টি নেই।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের বক্তব্যে হুমকির সূর অব্যাহত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের কথায় তা হ্রাস পায়। তিনি কিছুটা ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, ‘তুরস্ক গণভোটকে বাতিল বলে বিবেচনা করে। তবে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ব্যর্থ হলেই কেবল সামরিক অপশন ব্যবহার করা হবে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, ‘ইরাকের উত্তরাঞ্চলে তুর্কিরা হুমকির মুখে পড়লে হস্তক্ষেপ করতে তুরস্ক কোনো দ্বিধা করবে না।’ বক্তব্যের এই শেষ অংশ দেখে মনে হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ জনগণের মতামতের দিকে লক্ষ রেখেই এ বক্তব্য দেয়া হয়েছে। কারণ বারজানি সম্ভব সব কিছু করবেন। কোনো দেশ বিশেষভাবে তুরস্ককে অতিরিক্ত কোনো মিথ্যা ওজর দেখাবে না। এ পর্যন্ত তিনি যা অর্জন করেছেন তা নষ্ট করার জন্য কোনো ক্ষমা চাইবেন না। অপর দিকে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই পরিস্থিতিকে সংযত তথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই তা হবে তুরস্কের জন্য বড় ধরনের সফলতা।
ইসরাইল ছাড়া সব স্টেকহোল্ডারই ইরাকের আঞ্চলিক অখণ্ডতার ওপর কম-বেশি জোর দিয়েছে। তারা ইরাকি কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করছে। তবে তাদের নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস বা আস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। অন্য স্টেকহোল্ডারদের দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা নিয়ে তুরস্কের শঙ্কা ও সন্দেহ রয়েছে। তুরস্ক মনে করে, তারা হয়তো কুর্দিদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছার একটি পথ খুঁজে পাবে এবং ঠাণ্ডামাথায় তুরস্ককে এর বাইরে রাখবে। কারণ তুরস্ক হচ্ছে একমাত্র দেশ, যে কেআরজি অথবা স্বাধীন কুর্দিস্তানের সাথে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে পারবে না। সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনা বজায় থাকলে ইরাক ছাড়া অন্য সব দেশের চেয়ে তুরস্ক অধিক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ইরাকি কুর্দিস্তানে তুরস্কের নির্মাণ, ব্যবসায় ও খুচরা বিক্রয় কোম্পানিগুলো অত্যন্ত সক্রিয়। কুর্র্দিদের জন্য রাজস্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস হচ্ছে জ্বালানি তেল। আর এই তেল বিপুল পরিমাণে রফতানি করা হয় যে পাইপলাইনের মাধ্যমে, তা শেষ হয়েছে তুরস্কে গিয়ে। অতীতে বাগদাদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও আঙ্কারা কেআরজির জন্য লাভজনক এই পাইপলাইন তৈরি করেছিল। তুরস্ক তার সীমান্ত বন্ধ করে দিলে কেআরজি এবং ইরাক উভয়ের কাছ থেকে দেশটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ইরাক হচ্ছে তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিবাজার। ইরাকি কুর্দিস্তানের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের বিরোধিতাকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় আঙ্কারার বেশি ক্ষতি হবে। ইরবিলের সাথে একটি গঠনমূলক সম্পর্ক রক্ষা করার ওপরই তুরস্কের স্বার্থরক্ষা নির্ভর করবে।
তুরস্ক এবং কেআরজির মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীল বহু স্বার্থ রয়েছে। বিরোধ মীমাংসা করার জন্য এগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরাকি কুর্দিস্তানের কান্দিল পর্বতমালায় অবস্থানরত পিকেকের সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে অধিকতর দক্ষতায় যুদ্ধ করার জন্য কেআরজির সাথে সংশ্লিষ্ট আন্তঃনির্ভরশীল স্বার্থকে ব্যবহার করতে পারে তুরস্ক। দৃঢ় প্রতিশ্রুতি সত্ত্বে¡ও কয়েক দশক ধরে এই সহযোগিতা অকার্যকর বা নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। এই সময়ে অধিকতর কার্যকর একটি উপায় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারেÑ যাতে এটা কেআরজিকে সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসতে সুযোগ করে দেবে। দ্বিতীয়ত, ইরাকি সংবিধানের ১৪০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কিরকুক শহর হচ্ছে একটি বিতর্কিত এলাকা। ইরাকে ১৯৫৮ সালে সর্বশেষ নিরপেক্ষ আদমশুমারি করা হয়েছিল।
এরপর সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক পরিচালিত আরবীয়করণ অভিযানের মাধ্যমে ওই শহরের জাতিগোষ্ঠীগত কাঠামো পাল্টে দেয়া হয়। সাদ্দামের পতনের পর কুর্দি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে কিরকুকে কুর্দিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। তারা দাবি করেন যে, এসব কুর্দিকে সাদ্দাম হোসেন তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন। তাই কিরকুকের জাতিগোষ্ঠীগত কাঠামোতে দু’টি বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। জোর করে কুর্দিদের বাস্তুচ্যুতি বা দেশান্তর এবং পুনর্বাসনের নেতিবাচক প্রভাব দূর করার জন্য তুরস্ক কেআরজির সাথে একটি সমঝোতায় আসার জন্য আলাপ-আলোচনা করতে পারে। শহরটির জাতিগোষ্ঠীগত গঠন বা কাঠামো যতদূর সম্ভব আগের তথা মূল কাঠামোর কাছাকাছি অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে আলোচনা করতে পারে। এতে অবশিষ্ট বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ডগত ইস্যুগুলো সমাধানের পথও বেরিয়ে আসতে পারে।
এই গণভোট তুরস্ক এবং কেআরজি উভয়ের জন্য ঝুঁকি ও সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। টেবিলে সব অপশন আছে। তারা কোন অপশনটি বেছে নেবেন বা গ্রহণ করবেন তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে নেতৃবৃন্দকেই।
লেখক : তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং
ক্ষমতাসীন একে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস