মোদিকে জিতিয়েছিলেন যিনি, হারাচ্ছেনও তিনি!
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ব্র্যান্ডিং, বিপণন, ইত্যাদি কৌশলগুলো যে রাজনীতিতেও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, প্রশান্ত কিশোর সেটা আগেই প্রমাণ করেছিলেন। প্রথমে ২০১২ সালের গুজরাট বিধানসভা ভোট, তার পর ২০১৫ সালের লোকসভা ভোটে। অতিমানবীয় উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির ভাবমূর্তি।
২০১৫ বিহার বিধানসভা ভোটেও নীতীশ–লালুর মহাজোটের সাফল্যের পিছনে সেই প্রশান্ত–ম্যাজিক। রাজনীতি যে শুধু রাজনীতিকদের কারবার নয়, ভারতে এই ধারণার আমদানি করেছেন প্রশান্ত। অঙ্ক কষে এমনকি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া থামিয়ে দেওয়া যায়, প্রমাণ করেছেন। ২০১২ গুজরাটে মোদি এবং ২০১৫ বিহারে নীতীশ, দুজনেরই তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার লড়াই ছিল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে।
দু জায়গাতেই রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন প্রশান্ত। যদিও কোথায় গুজরাটের ধুরন্ধর ব্যবসায়ীরা, আর কোথায় খেতিবাড়িতে অভ্যস্ত মেঠো বিহারীরা! তবু সফল জাতিসংঘের সাবেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোর। মোদির সঙ্গ ছেড়ে যেদিন নীতীশ শিবিরে এলেন, সেদিনই বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। সসম্মান উতরে গেলেন।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের কাজ ছেড়ে ভারতে ‘সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নেন্স’ (সি এ জি) নামে এক সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন প্রশান্ত। ২০০৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার এবং নানা গণসংযোগ কৌশল সফলভাবে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বারাক ওবামা। ২০১২ সালেও ওবামার জনসংযোগদল একই ঘটনা ঘটিয়েছিল। অভিভূত হয়েছিলেন প্রশান্ত।
ভারতে এই নির্বাচনী প্রচার কৌশল প্রয়োগের পথ খুঁজছিলেন। পেয়ে যান নরেন্দ্র মোদিকে। লোকসভা নির্বাচনের সময় মোদির ‘চায়ে পে চর্চা’ বা তার হলোগ্রাম অবতারে আবির্ভাব— সবের পিছনে ছিল প্রশান্তর মস্তিষ্ক। পরে বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মোদির সঙ্গ ছাড়েন। তাকে প্রায় লুফে নেন নীতীশ। ভুল যে করেননি তা আজকের ফলে প্রমাণিত।
জাতপাতে দীর্ণ এক রাজ্যে কাজ করতে এসে নিজেকেও বদলে নিয়েছিলেন প্রশান্ত। নীল জিন্স–সাদা টি শার্টের বদলে তাকে দেখা গেছে ধবধবে সাদা কুর্তা–পাজামায়। যে কোনও কাজের আগেই হোমওয়ার্ক করে নেওয়াটা স্বভাব। বিহারে জিন্স–টি শার্ট চলবে না, বিজাতীয় পোশাকে ভুরু কুঁচকোতে পারে দলের নেতা–কর্মীদের, জানতেন। ফলে ভোলবদল। তবে কাজের ধরন বদলাননি। সংযুক্ত জনতা দলে ফেস্টুন থেকে প্রচার সর্বত্র তার উপস্থিতি।
লালুপ্রসাদ যাদব বা নীতীশ কুমারদের হোর্ডিংয়ের রঙ থাকত সবুজ–সাদা। ম্যাড়মেড়ে এই রঙের বদলে প্রশান্ত আমদািন করলেন উজ্জ্বল লাল–হলুদ। নতুন লুকের পাশাপাশি একটা চনমনে ব্যাপার এল। যুবকদের কাছে দলের পোস্টার অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হল। বিহারে এই প্রথম বাড়ি বাড়ি প্রচারে নামান হল মহিলাদের। যা নিয়ে চর্চা কম হয়নি। ‘জি পি এস’ লাগানো সাইকেল নিয়ে মহিলারা সংযুক্ত জনতা দলের হয়ে নীতীশের ছবি নিয়ে ভোট চাইতেন। আগে এই কাজে দেখা যেত পুরুষদের।
নিজে পারতপক্ষে প্রচারে বের হতেন না প্রশান্ত। নিজে ব্রাহ্মণ হয়ে লালু–নীতীশের মতো দুজন পিছড়ে বর্গের নেতার হয়ে কথা বললে যে উঁচু জাতের লোকেরা বিরূপ হতে পারেন, সেটা বুঝতেন। আসলে বিহারে জাতপাতের সংস্কৃতি অনেকের থেকেই ভাল বোঝেন প্রশান্ত। তাঁর বাবা, যিনি পেশায় ডাক্তার, বিহারের বক্সার জেলার লোক। তবে সেই বিহার–যোগ নয়, নিজের মামারবাড়ির পরিচয় বেশি দিতেন প্রশান্ত।
তার মা উত্তরপ্রদেশের বালিয়ার মেয়ে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের জেলা বালিয়ার সঙ্গে আবার বিহারের সম্পর্ক বহু বছরের। ধানবাদের কয়লাখনি এলাকায় অধিকাংশ খনিমালিক এবং তাদের পোষা গুন্ডারা সবাই আসে বালিয়া থেকে। খনিশহর ধানবাদেই দীর্ঘদিন ডাক্তারি করেছেন প্রশান্তর বাবা। তাই প্রশান্ত কিশোর বুঝতেন বিহারের রাজনীতি কোন পথে চলে।
তবে প্রশান্ত কিশোরের সাফল্যের পিছনে আরও এক সূক্ষ্ম কারণ আছে। যার বা যে দলের হয়েই প্রচার করুন না কেন, তিনি এবং তার দল মতাদর্শগতভাবে নিরপেক্ষ থাকে। এই শিক্ষাও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকেই নেওয়া। নিজেদের ওরা বলেন, আদর্শগত নিরীশ্বরবাদে বিশ্বাসী, যারা কেবল দক্ষ পেশাদারের মতো নিজেদের কাজটা নিখুঁত করতে শিখেছেন।
এই নিরপেক্ষ পেশাদারিত্বের দাম বেশ চড়া রাখেন প্রশান্ত কিশোর। যারা সেই দাম দিতে পারবে, তিনি তাদের হয়েই নেমে পড়বেন মাঠে। কাজেই ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর দলকে আবার যে নরেন্দ্র মোদির প্রচারের দায়িত্ব নিতে দেখা যাবে না, এমন কথা হলফ করে বলা যায় না।
৯ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি