ফরীদ আহমদ রেজা: তুরস্কের একে পার্টি কোন ইসলামী দল নয়, একটি সেকুলার দল। সেকুলারিজম তাদের ঘোষিত নীতি। একে পার্টির প্রধান এরদোগান প্রচলিত অর্থে ইসলামিস্ট বা ইসলামী স্কলার নয়। একে পার্টি কামালিস্ট না হলেও তুরস্কের স্বাধীনতা রক্ষায় কামাল পাশার অবদানকে তারা স্বীকৃতি প্রদান করে। তুর্কি জাতীয়তাবাদকে তারা লালন করে। সেকুলারিজম প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণার কোন অঙ্গীকার তাদের নেই।
ক্ষমতায় আসার পর তাদের দুটো ইসলামী পদক্ষেপ সবচেয়ে দৃশ্যমান। এক, মহিলাদের মাথায় স্কার্ফ পরিধানের অধিকার প্রদান। এটা মৌলিক মানবিক অধিকারের ভিত্তিতে প্রদান করা হয়েছে। ইতোপূর্বে তুরস্কে তা নিষিদ্ধ ছিল। একে পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে স্কার্ফ পরার অপরাধে একজন মহিলা পার্লামেন্ট সদস্যকে সে দেশের নাগরিকত্ব হারাতে হয়েছে। দুই, মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং মুসলমানদের স্বার্থে সোচ্চার হওয়া।
অপরদিকে তুরস্ক প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যারা ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তুরস্ক ১৯৪৯ সালে তাদের স্বীকৃতি দেয়। তখন অবশ্য তুরস্ক কামালিস্টদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।২০০৮ সালে গাজা-যুদ্ধ এবং ২০১৩ সালে গাজা-ফ্লোতিল্লা আক্রমণের সময় তুরস্কের সাথে ইসরাইলের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। আবার চলতি বছর (২০১৬ সালে) একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে দুটো দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
তুর্কি তুরস্কের রাষ্ট্রভাষা। এটা সে দেশের শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা। অধিকাংশ মানুষ সুন্নি-হানাফি মুসলমান। প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ এথনিক দিক দিয়ে তুর্কি পরিচয় ধারণ করে। নিজের ভাষা এবং জাতীয়তাবাদী পরিচয়কে তারা গর্বের সাথে লালন করে। কুর্দি বংশোদ্ভূত মানুষ সেখানকার সর্ববৃহৎ এথনিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কুর্দিদের সাথে তুর্কিদের মনোমানিল্যের ইতিহাস অনেক পুরানো। মাঝে মাঝে তা সশস্ত্ররূপ ধারণ করে।
এরদোগানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের অসংখ্য অভিযোগ। বিরোধীদের প্রতি দমননীতি, কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ, পার্লামেন্টারি পদ্ধতি থেকে প্রেসিডেনশিয়েল পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া, একটি সেকুলার রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে ইসলামাইজেশনের পথে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি অভিযোগ ঘুরে-ফিরে বার বার বিভিন্ন মিডিয়ায় আলোচিত হয়ে আসছে।
এ সকল অভিযোগ নিছক রটনা নয়। সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থানের পর ঢালাওভাবে বিরোধীদের অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলেও এরদোগান সমালোচিত হচ্ছেন।
তুরস্কের মানুষ বার বার একে পার্টিকে ক্ষমতায় বসায় এ জন্যে নয় যে তারা ইসলামিস্ট বা এর নেতা মধুরস্বরে কুরআন তেলাওত করতে পারেন। তুরস্কের সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির ব্যাপারে তাদের দক্ষতার কারণে-ই মানুষ তাদের বার বার ভোট দেয়। ১৯৯৪-৯৮ পর্যন্ত এরদোগান ইস্তাম্বুল শহরের নির্বাচিত মেয়র ছিলেন।
মেয়র হিসেবে তার জনকল্যাণমূলক যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এরদোগানের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এবং মানুষের গড় আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একে পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে বিশ্ববাজারে টার্কিশ মুদ্রার তেমন মূল্য ছিল না।বৃটিশ মুদ্রা এক পাউন্ড দিয়ে একশ’র চেয়ে বেশি টার্কিশ লিরা পাওয়া যেত। আজকের বাজার দর অনুযায়ী (১৮ জুলাই, ২০১৬) চার টার্কিশ লিরা বৃটিশ এক পাউন্ডের সমমানের।জিডিপি’র বিচারে তুরস্ককে বিশ্বের ১৮ নম্বর উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভোটের সময় তুরস্কের মানুষ মসজিদের ইমাম নিয়োগের জন্যে ভোট দেয় না। ভোট দেয় দেশ পরিচালনার জন্যে। সচেতন মানুষ দেশের শান্তি, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ন্যায়-বিচার ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে তাদের ভোট প্রদান করে।
এ মাপকাঠিতে তুরস্কের জনগণ একে পার্টিকে এখনো সবচেয়ে যোগ্য বলে বিবেচনা করে। যখন যোগ্যতার মাপকাঠিতে একে পার্টি ফেল করবে তখন জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে।
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস