শুক্রবার, ০৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:৩৩:৪১

জাপানের সামরিক প্রস্তুতি, কিন্তু কার বিরুদ্ধে?

 জাপানের সামরিক প্রস্তুতি, কিন্তু কার বিরুদ্ধে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : টানা তৃতীয়বারের মতো জাপানের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন শিনজো আবে। গত রোববারের আগাম নির্বাচনে পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তার নেতৃত্বাধীন জোট। জাপানের এবারের নির্বাচনের মূল বিষয় ছিল সংবিধান সংশোধন করে জাপানকে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া। সাম্প্রতিক সময়ের আঞ্চলিক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে জাপানিদের একটি অংশ- আবে নিজেও তাদের একজন।

বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন ও চীনের আঞ্চলিক প্রভাব মোকাবেলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিকামী সংবিধান পাল্টে জাপান সামরিক কর্মকাণ্ডের দিকে যাবে কি না তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। নতুন মেয়াদে এই বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে সূর্যোদয়ের দেশের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রীকে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর যুদ্ধ বা সামরিক কর্মকাণ্ডকে পরিত্যাগ করে পুরোপুরি শান্তির পথে হাঁটতে শুরু করে জাপান। ১৯৪৭ সালের ৩ মে জাপানের জন্য নতুন সংবিধান প্রবর্তন করা হয়, যাতে যুদ্ধকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সেই সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি সংবিধানের খসড়াও তাদের করে দেয়া। সংবিধানের ৯ নম্বর ধারায় যেকোনো ধরনের বৈশ্বিক গোলযোগ মোকাবেলায় যুদ্ধ ঘোষণা করার অধিকার রহিত করা হয়েছে। রহিত করা হয়েছে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী রাখার অধিকারও।

তবে দেশটির প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে জাপান সেল্ফ-ডিফেন্স ফোর্স নামে একটি বাহিনী। এটি শুধুই দেশের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বাহিনী কখনো দেশের সীমান্তের বাইরে একটি গুলিও ছোড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তির অধীনে দেশটির নিরাপত্তার বিষয়ে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে থাকে ওয়াশিংটন।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে অস্থিশীলতা ক্রমেই বেড়ে চলছে। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার একের পর এক আগ্রাসী ও উসকানিমূলক পদক্ষেপ দেশটির ‘অস্তিত্ব হুমকির মুখে’ ফেলছে।

অনেক বছর ধরেই উত্তর কোরিয়া এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সামরিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। জাপান সাগরের এক দিকে কোরীয় উপদ্বীপ, অন্য দিকে জাপান। উত্তর কোরিয়া গত কয়েক বছরে তাদের অনেক সামরিক পরীক্ষা চালিয়েছে এই সাগরে। সর্বশেষ গত মাসে জাপানের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে কিম জং উনের দেশ।

এ ছাড়াও বেশ কয়েকবার জাপানের সমুদ্রসীমায় আছড়ে পড়েছে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ঘটনা জাপানের সার্বভৌমত্বের জন্য স্পষ্ট হুমকি। এ ছাড়া অঞ্চলটিতে চীনের প্রভাব বাড়ছে দ্রুত গতিতে। রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দ্বন্দ্ব। সব কিছু মিলে জাপানের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে অনেক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে।

অনেকেই বলছেন এসব পরিস্থিতিতে জাপানকে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর নিরাপত্তাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে নজর দেয়া উচিত। কেউ কেউ তো জাপানকে পারমাণবিক কর্মসূচির দিকেও যেতে উপদেশ দিচ্ছেন। জাপানের রাজনীতিকদের একটি বড় অংশও সামরিক পদক্ষেপ শুরু করতে চাইছে। শিনজো আবেও অনেক দিন ধরে বিষয়টির পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করছেন।

এবারের নির্বাচনে টানা তৃতীয়বার ও সব মিলে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হতে চলা আবে কিছু দিন আগে একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রথমত আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা জোরালো করতে চাই এবং যত বেশি সম্ভব মানুষকে রাজি করাতে চাই। বিষয়টিতে এখই গুরুত্ব দেয়া উচিত’। তাই কাগজে-কলমে যা-ই থাক, এবারের নির্বাচনে আবের মূল নির্বাচনী ফোকাস ছিল শান্তিবাদী সংবিধান পরিবর্তন করে সামরিক কর্মকাণ্ড শুরু করা। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের ফলে আবের এই মতের পক্ষে প্রাথমিকভাবে জনগণের সমর্থন পাওয়া গেছে সে কথা বলাই যায়।

তবে সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়টি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর জন্য গণভোট আয়োজন করে জনগণের সরাসরি মতামত নিতে হবে। বেশির ভাগ জনগণ পক্ষে রায় দিলেই কেবল তিনি সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবেন। আবেবিরোধীরা বলছেন, নির্বাচনে বিজয় এসেছে আবের শাসনপ্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থার কারণে। আবার যোগ্য বিরোধী দল না থাকাও একটি কারণ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাকে সংবিধান পরিবর্তনের লাইসেন্স দেয়া হলো। কাজেই এমন পদক্ষেপ নিলে যে শিনজো আবেকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তা ধরে নেয়া যায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই অতীতকে ভুলে সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে বড় করে দেখছেন। টোকিওর টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক জেফ কিংস্টন মনে করেন, শিনজো আবের স্বপ্ন তার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।

সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে আবে যদি গণভোটের দিকে যান, তাহলে উত্তর কোরিয়া ও চীনের কল্যাণে তিনি সে বাধাও পেরিয়ে যাবেন। অন্য দিকে বিশাল জয় পেলেও সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে আবের পক্ষে আসলে যথেষ্ট জনমত রয়েছে কি না, তা বড় প্রশ্ন বলে মনে করেন টোকিওর সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কোইচি নাকানো।

সামরিক পদক্ষেপ শুরু হোক বা না হোক জাপানকে এখন প্রতিদিনই ব্যস্ত সময় কাটাতে হবে উত্তর কোরিয়াকে মোকাবেলায়। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র হিসেবে কিমের যেকোনো ধংসাত্মক পদক্ষেপের শিকার হতে পারে জাপান। তাই নতুন মেয়াদে আবেকে এ বিষয়ে ব্যাপক তৎরতা চালাতে হবে। উত্তর কোরিয়ার সাথে কূটনৈতিক তৎপরতার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে।

২০০২ সালে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক অপহৃত জাপানিদের ফিরিয়ে আনতে আলোচক দলের প্রধান ছিলেন তিনি। সেই ঘটনা আবেকে প্রথমবারের মতো লাইমলাইটে নিয়ে আসে। আবের সামনে আছে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলার বিষয়টিও। এটি অবশ্য যতটা না সামরিক, তার চেয়েও বেশি অর্থনৈতিক। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক পদক্ষেপে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন আবে। তার ‘আবেনেমিক্স’ ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এতে বেকারত্ব কমলেও এর সমালোচনাও রয়েছে।

অনেকেই বলছেন, দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। শ্রমিকদের মজুরির হার রয়ে গেছে আগের মতোই। কাজেই নতুন মেয়াদে এ বিষয়গুলোও আবের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। এসব বিতর্ক থাকলেও চীনের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক প্রভাব মোকাবেলায় তার দেশকে আবে কতটা এগিয়ে নিতে পারবেন সেটিই হবে গুরুত্বপূর্ণ।
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে