প্যারিসে হামলাকারী স্যামিকে ফেরাতে যা করেছিলেন তার বাবা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দূর থেকেই হাসিটা দেখে ছেলেকে চিনতে পেরেছিলেন বছর সাতষট্টির আজ্জেদিন। তবে কাছে যেতেই বুঝতে পারেন, কেমন যেন বদলে গিয়েছে তার আদরের ছেলেটা। সবটা বুঝে উঠতে না পারলেও, কিছুটা আঁচ করেছিলেন। সেখান থেকেই তাই ছেলেকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বৃদ্ধ বাবা। আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এখবর দিয়েছে।
শুক্রবার প্যারিসে হামলার পরেই ওই বৃদ্ধের বলা টুকরো টুকরো কথাগুলোই মনে পড়ে যাচ্ছিল। এক বছর আগের সেই সাক্ষাৎকার গত কাল ফের ছেপেছিল ফরাসি সংবাদপত্র লা মন্দ।
ফরাসি সংবাদপত্র লা মন্দ জানাচ্ছে, প্যারিসের বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলে হামলা চালিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে জঙ্গি স্যামি আমিমুর। এই স্যামিই হল আজ্জেদিনের ছেলে। যাকে ফেরাতে বহু কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন ওই বৃদ্ধ।
ছেলেকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছিলেন তিনি। এমনকী আইএস জঙ্গিদের মূলঘাটিতেও পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাকে। গত বছর নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথাই আজ্জেদিন জানিয়েছিলেন ওই সংবাদপত্রকে। জানিয়েছিলেন, বাবা-মার প্রতিও বদলে গিয়েছিল ছেলের ব্যবহার।
অথচ কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল না স্যামি। আর পাঁচ জনের মতোই উত্তর-পূর্ব প্যারিসের এক শহরতলিতে পরিবারের সঙ্গে থাকতো স্যামি। বাস চালকের কাজ করতো। তবে ২২ বছর বয়স থেকেই আচমকা পাল্টে যেতে শুরু করেছিল ওই যুবকের হাবভাব। প্রায়শই তাকে মসজিদে দেখা যেত। শুধু তা-ই নয়, বাবা-মাকে টিভি দেখতেও বারণ করতে শুরু করেছিল সে। পাশাপাশি, মা-কে সবসময় বোরখা পরে থাকতেও বলতো।
স্যামির এমন বদলে যাওয়া হাবভাব দেখে অনেকেরই সন্দেহ হয়েছিল। ২০১২ সালে জঙ্গিতে যোগদানের বিষয় নিয়ে ফ্রান্সের প্রশাসন তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। এর পরেই স্যামি সিরিয়া পাড়ি দেয়। এবং সেখানে আইএস জঙ্গি দলে নাম লেখায়।
এ দিকে, আজ্জেদিন নানা ভাবে খবর পেতেন, প্রায়ই সিরিয়ার সেনাদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে অল্পবয়সি জঙ্গিরা। অথবা, বহু জঙ্গিকেই বন্দি করা হচ্ছে। এমন সব খবরে রীতিমতো আতঙ্কেই দিন কাটাতেন বৃদ্ধ। ভয়ে ভয়ে তার রাতদিন কাঁটতো, এই বুঝি ছেলের মৃত্যু খবর আসে।
এমন আশঙ্কা নিয়ে ক’দিনই বা সুস্থ ভাবে বাঁচা যায়! তাই কোনও অঘটন ঘটার আগেই তড়িঘড়ি ছেলেকে ফেরানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। কোনও রকমে বুঝিয়েসুজিয়ে ছেলেকে ফেরাতে পারলেই বিপদের সব মেঘ কেটে যাবে। এই ভেবেই আজ্জেদিন পাড়ি দিয়েছিলেন ইস্তামবুলে। তবে তার এই পরিকল্পনার কথা এক্কেবারেই জানতে দেননি স্যামিকে।
প্রথমে বিমানে ফ্রান্স থেকে ইস্তামবুল। তার পর সেখান থেকে বাসে চেপে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত। সেখানে পৌঁছে খবর দিয়েছিলেন ছেলেকে। স্যামিই তখন আজ্জেদিনেরর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল কয়েক জন পাচারকারীর। তারাই ওই বৃদ্ধকে নিয়ে গিয়েছিল মিনবেজে। আর সেখানে পৌঁছেই প্রথম আইএসের কালো পতাকা দেখেছিলেন আজ্জেদিন। সেই ঘটনার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, প্রথম চেক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালাে পতাকা হাতে এক জঙ্গি। এর পর সেখানে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আজ্জেদিনের পাসপোর্টও।
পর দিন আইএস জঙ্গিরাই ছেলের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন আজ্জেদিনকে। ছেলের সঙ্গে এত দিন পর দেখা হবে ভেবে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারছিলেন না তিনি। ভেবেছিলেন, ছেলের থেকেও এমন প্রতিক্রিয়া পাবেন। বহু দিন পর হয়তো বাবাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। বাবাকে দেখে কেমন যেন ঠাণ্ডা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল স্যামি। অন্য রকম লাগছিল এত দিনের চেনা ছেলেটাকে। সে দিন প্রায় সারা দিনটাই কাটিয়েছিলেন ছেলের সঙ্গে। কিন্তু কখনওই বাবা-ছেলেকে একলা ছাড়েনি জঙ্গিরা।
এর পর বিকেলের দিকে আজ্জেদিন স্যামির হাতে দিয়েছিলেন তার মায়ের হাতে লেখা চিঠি। সেই চিঠির ভাঁজে লুকনো ছিল ১০০ ইউরো। এক কোণে গিয়ে ভাঁজ খুলে চিঠিটা পড়েছিল স্যামি। কিন্তু তার পরেই ফিরে এসে ওই ১০০ ইউরো ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমার টাকা-পয়সার দরকার নেই।’
ছেলের কাছে গিয়ে দু’দিন ছিলেন আজ্জেদিন। তবে ওই দু’দিনেই বহু অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। সিরিয়া সেনা জঙ্গিদের উপর চরম অত্যাচার করছে, এমন কিছু ভিডিও তাকে দেখিয়েছিল ওই জঙ্গিরা। পাশাপাশি, এমন অনেক ছবিও তাকে দেখানো হয়েছিল, যা দেখে রীতিমতো তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন আজ্জেদিন। ফেরার সময়ও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্ত পেরোনোর সময় আলাপ হয় এক ফরাসি তরুণীর সঙ্গে। কোলে ছ’মাসের একটা বাচ্চা। নির্লিপ্ত ভাবে সে জানিয়েছিল, কী ভাবে আত্মঘাতী হামলা করতে হয়, সেই প্রশিক্ষণই নিচ্ছে তার স্বামী। অবাক হয়ে এ ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তরুণী বলেন, ‘এ নিয়ে আমি খুবই খুশি।’
১৮ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই
�