শনিবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ০৯:৪০:১৯

‘বিয়েবাড়িতে কী করে যাব, ওরা তো এখন মর্গে!’

‘বিয়েবাড়িতে কী করে যাব, ওরা তো এখন মর্গে!’

রোহান মণ্ডল : প্রায় চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটে গেল! ভাবতেই পারিনি, এ ভাবে ওরা...

কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। চোখের পলক ফেললেই, ছবিটা সটান ভেসে উঠছে। আচমকা বাসটা ওদের উপর উঠে পড়ল বিশাল জোরে...আমরা কাছে যাওয়ার আগেই প্রায় পিষে গেল সঞ্জয়-বিশ্বজিৎ। সাইকেলটা ছিটকে পড়ল এক দিকে। আর মিষ্টিগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তায়। রক্তে-রসে-মিষ্টিতে...

কিছু ক্ষণ আগেই আমরা সকলে খুব হাসাহাসি করছিলাম। ভাবতেই পারিনি, কয়েক মুহূর্ত পরেই এমনটা হবে...আসলে আজ সায়নের দাদার বিয়ে। কয়েক দিন ধরেই আমরা সকলে খুব আনন্দে ছিলাম। সকাল থেকে রাত— প্ল্যান করে রেখেছিলাম গোটাটা। কে কী পরব, কখন কোথায় যাব, বিয়েবাড়িতে কী কী খাব, বৌভাতের দিন কী করব...কিন্তু, সব প্ল্যান ভেস্তে দিল সঞ্জয়-বিশ্বজিৎ। রাস্তায় যে ভাবে চেপ্টে গিয়েছে, বিশ্বাস করুন, তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। এখনও পারছি না। জল সব ঝাপসা করে দিচ্ছে।

সাতসকালেই সায়নদের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম। মেয়ের বাড়িতে তত্ত্ব পাঠাতে হবে, তারই গোছগাছ করতে। সবাই এসেছিল। তার পর, কার কী কাজ বুঝে নিয়ে সাইকেলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সাজানোটাও আমাদের দায়িত্ব ছিল। তারই জিনিসপত্র কিনতে বেলেঘাটা চত্বরে গিয়েছিলাম সকলে। আমি একটা অন্য দোকানে, জরির পাড় কিনতে গিয়েছিলাম। সঞ্জয়-বিশ্বজিতের উপর ছিল মিষ্টির দায়িত্ব। কেনাকাটা সেরে সকলে মিলেই সাইকেলে ফিরছিলাম। আমাদের সঙ্গে সায়নও ছিল। বিশ্বজিৎ আর সঞ্জয় ছিল একই সাইকেলে।

তিনশো মিটার দূর হয়তো! বিল্ডিং মোড়টা পেরিয়ে চিংড়িঘাটার দিকে এগোচ্ছি...সঞ্জয়দের সাইকেলটা বাইপাস পেরিয়ে সুকান্তনগরের দিকে পার হবে...ঠিক তখনই একটা বাস টার্ন নিয়ে ওদের সাইকেলের উপর উঠে পড়ল হুড়মুড়িয়ে।

কাছের পুলিশ বুথটায় ছুটে গেলাম। তত ক্ষণে সব বন্ধুরা চলে এসেছে। ছুটে এসেছে আমাদের পাড়ার লোকজনও। কিন্তু, পুলিশ আমাদের কথা শুনতেই চাইছিল না। বেপরোয়া বাসটাকে আটকানোর কোনও চেষ্টাই করল না, জানেন। মিনিট পাঁচেক পরে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেল আমার দুই বন্ধুকে। এনআরএস হাসপাতালে। এখন তো ওরা মর্গে।

খুব ভাল ফুটবল খেলত বিশ্বজিৎ। তবে, একটা সময়ের পর ছেড়ে দেয়। আর সঞ্জয় তো আমার সঙ্গে রেগুলার মাঠে নামত। ওর ড্রিবলিং দেখলে সকলের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হত। সঞ্জয়ের তো শুধু মা রইলেন। বাবা তো আগেই...

জানেন, পুলিশ একটু তৎপর হলে আমার বন্ধুদের যেমন বাঁচানো যেত, তেমন আজকের গণ্ডগোলটাও হয়তো এড়ানো যেত। ওই মোড়টা এত বিপজ্জনক, তা-ও ওরা কেন এত উদাসীন! বিধায়ক সুজিত বসুকেও আমরা একই কথা বলেছি।

ছোটবেলার বন্ধু সঞ্জয়-বিশ্বজিৎদের সঙ্গে কয়েক হাজার বার মাঠে নেমেছি। কত ঝগড়া, অশান্তি, মারামারি... সব খেলা নিয়েই। মাঠই জীবন ছিল আমাদের। বিশ্বাস করুন, এমন ঠান্ডা, এমন চুপচাপ ওদের কোনও দিন দেখিনি। সঞ্জয়ের পা-টা কেমন মুচড়ে গিয়েছিল। ওই পা দিয়েই তো ড্রিবলিং করত! ডজ করত।

আজ যে কেন বাসটাকে ডজ করতে পারল না!

লেখক : ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, মৃত দুই তরুণের বন্ধু

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে