রবিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ১১:২৯:১১

১১ দিন না ঘুমিয়ে বিশ্ব রেকর্ড

১১ দিন না ঘুমিয়ে বিশ্ব রেকর্ড

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ১৯৬৪ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোর এক স্কুলছাত্র হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। একটানা এগারো দিন না ঘুমিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন ১৭ বছরের র‌্যান্ডি গার্ডনার। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় কী করা যায়- এরকম একটি ভাবনা থেকে ঘটনার শুরু। র‌্যান্ডি ও তার বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মানুষের ঘুম নিয়ে কোনো একটা পরীক্ষা চালাবে তারা।

সেই বন্ধুদের একজন ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলেন, আমরা ছিলাম আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। বিজ্ঞান মেলায় দেখানোর জন্য আমরা কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম। প্রথমত দেখতে চেয়েছিলাম, মানুষ যদি না ঘুমায়, তাহলে এর ফলে তার কোনো আধিভৌতিক ক্ষমতা তৈরি হয় কিনা। আমরা বুঝতে পারলাম, এটা করা কঠিন। তখন দেখতে চাইলাম, মানুষকে ঘুম থেকে বঞ্চিত করা হলে সেটার কী প্রভাব পড়ে তার সজ্ঞান আচরণে কিংবা বাস্কেটবল খেলায় বা অন্য যে কোনো কাজে।

এরপর ব্রুস ও তার বন্ধু র‌্যান্ডি গার্ডনার সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা একটানা জেগে থাকার বিশ্ব রেকর্ড ভাঙবেন। তখন এ বিশ্বরেকর্ডটি ছিল হনলুলুর এক ডিজের। একটানা ২৬০ ঘন্টা অর্থাৎ এগারো দিনের একটু কম সময় জেগে ছিলেন তিনি।

উইলিয়াম ডিমেন্ট তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক। তিনি বলেন, আমি এ ঘটনার কথা প্রথম পড়ি সংবাদপত্রে। সান ডিয়েগোর পত্রিকায় এই ছেলেটাকে নিয়ে একটা খবর বেরিয়েছিল। সে নাকি না ঘুমিয়ে একটানা জেগে থাকার একটা নতুন রেকর্ড করতে চায়। কাজেই আমি সাথে সাথে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, যাতে আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারি ও দেখতে পারি কিভাবে ব্যাপারটা কাজ করছে।

উইলিয়াম ডিমেন্ট এখন ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক। বিশ্বে ঘুম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তাকে পথিকৃৎ বলে মনে করা হয় র‌্যান্ডি গার্ডনার, তার বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার ও অন্যরা মিলে ঘুম নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন।

ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলেন, আমরা একটা কয়েন দিয়ে টস করে ঠিক করছিলাম, একটানা জেগে থাকার এই রেকর্ডটি কে করবে। আমি খুশি ছিলাম যে র‌্যান্ডির ভাগ্যেই এই দায়িত্বটা পড়ল। আমি হয়তো ওর চেয়ে অনেক আগেই ঝিমিয়ে পড়তাম। র‌্যান্ডিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাকেও ওর সঙ্গে জেগে থাকতে হচ্ছিল। ওর ওপর নানা ধরণের পরীক্ষা চালাতে হচ্ছিল। কিন্তু তিন রাত ধরে নির্ঘুম থাকার পর একদিন দেয়ালের ওপর গিয়ে টলে পড়লাম। তখন আমরা বুঝতে পারলাম, অন্য কাউকে এই কাজের জন্য নিয়ে আসতে হবে। তখন আমাদের আরেক বন্ধু জো মার্সিয়ানোকে অনুরোধ করলাম এই কাজে যোগ দিতে। জো রাজি হলো। আর ওই একই সময়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক উইলিয়াম ডিমেন্টও এসে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে।

উইলিয়াম ডিমেন্ট বলেন, সে সময় গোটা দুনিয়ায় সম্ভবত আমিই একমাত্র গবেষক, যার কিছু কাজ ছিল ঘুম নিয়ে। র‌্যান্ডির বাবা-মা খুব হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন যে, আমি এই কাজে যুক্ত হয়েছি। এই একটানা না ঘুমানোর ফলে র‌্যান্ডির কোনো ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করছিল তার বাবা-মা।

এর আগে বিড়ালের ওপর এ ধরণের গবেষণা হয়েছিল। কিছু বিড়ালকে ১৫ দিন পর্যন্ত জাগিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরপর বিড়ালগুলো মারা যায়। র‌্যান্ডির বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলেন, সেসব বিড়ালকে জাগিয়ে রাখা হয়েছিল নানা রকম রাসায়নিক প্রয়োগ করে। তখনো কেউ জানতো না যে, সে কারণেই বিড়ালগুলো মারা গিয়েছিল। র‌্যান্ডি মাঝে মধ্যে কোক খেত। কিন্তু এছাড়া আর কিছু নয়। ডেক্সিড্রিন, বেনজিড্রিন বা এ জাতীয় কোনো উদ্দীপক ওষুধ নেয়নি ও।

ঘুম নিয়ে এই পরীক্ষা চলছিল সান ডিয়েগো ব্রুসের বাবা-মা'র বাড়িতে। উইলিয়াম ডেমেন্ট যখন সেখানে পৌঁছালেন, র‌্যান্ডিকে তখনও বেশ উজ্জীবীত দেখাচ্ছিল। র‌্যান্ডির ওপর তখন নানা রকম পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্রুস ম্যাকলিস্টার ও তার বন্ধুরা। ব্রুক বলেন, তখন যতো রকমের পরীক্ষা চালানো সম্ভব, আমরা আমরা তরুণ সৌখিন বিজ্ঞানীরা তা চালানোর চেষ্টা করছিলাম। এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পেলাম, ধীরে ধীরে তার সজ্ঞান থাকার ক্ষমতা, এমনকি তার ইন্দ্রিয় অনুভূতির ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সে হয়তো বলতে লাগলো, ওই গন্ধটা আমার ভালো লাগছে না, আমাকে ওটার গন্ধ শুকতে বলো না। তবে সে বাস্কেটবল খেলায় ভালো করছিল।

উইলিয়াম ডেমেন্ট বলেন, রাতের পর রাত জেগে থাকার কারণে বড় কোনো শারীরিক অসুবিধা হয়নি র‌্যান্ডির। সে শারীরিকভাবে খুবই ভালো ছিল। কাজেই আমরা তাকে বাস্কেটবল খেলতে নিয়ে যেতাম, বোলিংয়ে নিয়ে যেতাম। যদি তখন সে চোখ বন্ধ করতো, তাহলে কিন্তু সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়তো। ও যখন চোখ বন্ধ করতো, আমি বলতাম, র‌্যান্ডি চোখ খোলো। ও যখন চোখ খুলতো না, আমি তখন তাকে খোঁচা দিতাম। তবে তাকে এভাবে খোঁচা দেয়ায় সে বিরক্ত হয়নি।

ব্রুস ম্যাকালিস্টার বলেন, সেসময়ে যুক্তরাষ্ট্রে জন এফ কেনেডির হত্যাকান্ড ও পপ ব্যান্ড বিটলসের সফরের পর এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচিত সংবাদ। কিন্তু আমাদের জন্য তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেজ্ঞ র‌্যান্ডিকে কিভাবে সজাগ রাখা যায়। এজন্য আমাদেরও কষ্ট করে রাত জাগতে হচ্ছিল তখন। আমরা ওকে মধ্যরাতে গান শোনাতাম। ওকে সজাগ রাখতে আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছিল। কারণ মধ্যরাতে তো আর তেমন কিছু করার থাকে না। আমরা দিনের বেলায় অনেক কিছু করতাম। কিন্তু রাত ছিল ভয়ংকর। কারণ র‌্যান্ডিকে জাগিয়ে রাখা শুধু নয়, আমাদেরও জেগে থাকতে হতো।

কষ্ট করে হলেও তারা এই পরীক্ষা চালিয়ে গেলেন। ১১ দিনের এই দীর্ঘ পরীক্ষা শেষে র‌্যান্ডি তার বাবা-মার বাড়ির বাইরে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে অনেক সাংবাদিক দল জড়ো হয়েছিলেন। তারা র‌্যান্ডিকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলেন। একজন প্রশ্ন করলো, এই পুরো পরীক্ষার অর্থটা কী দাঁড়ালো? র‌্যান্ডি জবাব দিয়েছিল, এর মাধ্যমে প্রমাণ হলো, মানুষের শরীরের চাইতে মন অনেক বেশি শক্তিশালী।

এভাবে র‌্যান্ডি না ঘুমিয়ে একটানা ২৬৪ ঘন্টা অর্থাৎ প্রায় এগারো দিন জেগে ছিল। এরপর সে একটানা ১৪ ঘন্টা ঘুমিয়েছিল। তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছিল, কারণ তার বাথরুম পেয়েছিল। সূত্র: বিবিসি।
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে