শনিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৮, ০৮:১৬:০৪

'ইরাক আগ্রাসন একবিংশ শতাব্দীর জঘন্যতম পাপ'

 'ইরাক আগ্রাসন একবিংশ শতাব্দীর জঘন্যতম পাপ'

তালহা আবদুলরাজাক: জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন কর্তৃক আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক একটি আক্রমণ শুরুর মধ্য দিয়ে ১৫ বছর আগে আজকের দিনে ইরাক নরকে পরিণত হয়।

এখন পর্যন্ত কুখ্যাত হয়ে থাকা ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’ শুরুর বক্তব্যে বুশ ইরাকি জনগণকে বলেছিলেন, ‘তাদের স্বাধীনতার দিন খুবই নিকটে।’ কিন্তু ওই অঞ্চল মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের একটি ঘাঁটি হওয়ার পরিবর্তে ওই হামলার কারণে ইরাক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং লাখ লাখ ইরাকি এমন দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন, যা এ গ্রহটির অন্য মানুষেরা দেখা তো দূরের কথা, কল্পনাও করতে পারেনি।

যুদ্ধের কারণে দেশটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সাংঘর্ষিক জোনে পরিণত হয়েছে। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী জঙ্গি গ্রুপগুলো, বিদেশি শক্তি এবং রাজনৈতিক দলগুলো ইরাকি জনগণের জীবনের বিনিময়ে ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে সেখানে।

কেবল ইরাকিদের আক্রান্ত হওয়া (সেটাও ভয়ানকের চেয়ে বেশি) ছাড়াও ইরাক আক্রমণের ছিল বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া। ইরাকে গণতন্ত্র রফতানির মার্কিন প্রচেষ্টার শোচনীয় ব্যর্থতা দেশটিতে চরমপন্থী আদর্শগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে। বিষয়টিকে বর্তমানে ইরাকে আইএস ও ইরানের বিপ্লবী বাহিনীর অনুগত জঙ্গি সংগঠনের মতো রক্তচোষা দলগুলোর অধিক হারে উপস্থিতি দিয়ে বোঝা যেতে পারে।

ইরাক আক্রমণের প্রভাব একটি আঞ্চলিক সমস্যা তৈরি করেছে, যা ইউরোপের বুকে শরণার্থী সমস্যা উসকে দিয়েছে এবং পশ্চিমে অতি উগ্রপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগিয়ে তুলেছে।

ইরাক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে সহিংসতার ‘পেন্ডোরার বক্স’ খুলে দেয়া হয়েছে। যদিও নিঃসন্দেহে বাথ পার্টির প্রশাসনের আওতায় ইরাকে সহিংসতা ও দমন-পীড়ন ছিল; কিন্তু তাদের জায়গায় যা বসানো হয়েছে, তা আরও বেশি বাজে প্রমাণিত হয়েছে। আগ্রাসন-পরবর্তী ইরাকেই কিন্তু আল কায়দা ও আইএসের মতো গ্রুপগুলো বেড়ে উঠেছে।

বাথ পার্টির ইরাকে আল কায়দা একটি শক্তি ছিল বলে মনে করা হয় এবং গ্রুপটি ছিল দমিয়ে ফেলার পর্যায়ে; কিন্তু জঙ্গি গ্রুপটি আগ্রাসন-পরবর্তী ইরাকে কর্মী সংগ্রহের উর্বর ভূমি খুঁজে পেয়েছে। আল কায়দা বুশের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধকে ক্রুসেডের চরিত্র দিয়ে ব্যবহার করেছে এবং বিশ্বজুড়ে যোদ্ধাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের আগে দেশটিতে আল কায়দার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পর গ্রুপটি ইরাকে শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আভির্ভূত হয় এবং বৈশ্বিক সদস্য সংগ্রহের হারও প্রচুর পরিমাণে বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়। ইরাক আক্রমণের কারণে সৃষ্ট ক্ষমতাশূন্য পরিস্থিতি আবু মুসাব-আল জারকাবির মতো ব্যক্তিকে রাতারাতি প্রতাপশালী যুদ্ধবাজে পরিণত করে। যদিও জারকাবি ২০০৬ সালে নিহত হন, তার তীব্র শিয়াবিরোধী আদর্শ ইরাকে তৎপর কট্টর শিয়া ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং দেশটিতে সহিংস সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা বর্তমান সময় পর্যন্ত সেখানে রয়ে গেছে।

এসবই ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কায়েমের প্রেক্ষাপটে। এ কারণেই ইরাকে তীব্র পর্যায়ের সহিংসতা তৈরি হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পথ প্রশস্ত করেছে।

দ্যা লানসেট প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৬ সাল পর্যন্ত আগ্রাসনের সরাসরি ফল হিসেবে প্রায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার ইরাকি প্রাণ হারিয়েছেন। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা স্যার রয় আন্ডারসন ইরাক আগ্রাসনের প্রথম তিন বছরে ভোগান্তির শিকার ইরাকিদের প্রাণ হারানোর ঘটনা তুলে আনার জন্য গবেষণা কর্মটিকে বলিষ্ঠ বলে প্রশংসা করেছেন।

এ মৃত্যুর লাইন যে ২০০৬ সালের পরিসংখ্যানের পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক দীর্ঘ হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। মার্কিন বাহিনীর হামলার পর শিয়া-সুন্নি জাতিগত দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধে সহিংসতা আরও বেগবান হয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে আরও বেশি। এ সুযোগে স্বল্প সময়ে দেশটিতে আইএসের ভিত গড়া এবং ২০১৪ সালে গ্রুপটির হাতে মসুলের দখল নেয়া সহজ হয়েছে।

যা হোক, ইরাক আগ্রাসনের কারণে হাজার হাজার ইরাকি নাগরিককে নিরাপত্তার খোঁজে তাদের বিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তাদের কিছু মানুষ প্রতিবেশী সিরিয়া, জর্ডান ও তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে এবং বাকিরা ইউরোপের দিকে পালাতে শুরু করেছে। এদের অনেকে সুইডেনের মালমো শহরের মতো বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নিয়েছে, যেখানে তাদের নানামুখী হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে।

ইরাক আগ্রাসনের বৈশ্বিক ফল কেবল দুঃস্বপ্নের ঘোরে থাকা ইরাকিদের একা সমস্যায় ফেলেনি, এর একটি বিস্তৃত প্রভাবও রয়েছে। এ প্রভাবের কারণে সাদ্দাম-পরবর্তী যুগে ইরাকে নিজেদের টেকসই অবস্থান করে নিয়েছে ইরান। বাগদাদ প্যাঁচিয়ে গেছে সিরিয়া সংঘাতে।

ইরাক বর্তমানে সিরিয়ায় ইরানের সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে শিয়াপ্রধান দেশটি সিরিয়ার বাথ পার্টিকে রক্ষায় ছায়াযুদ্ধ করছে এবং পূর্ব ঘৌটার মতো বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক নাগরিকদের শির-েদে সহায়তা করছে ও বিশ্ব সম্প্রদায় সেটা দেখে যাচ্ছে।

সিরিয়া সংঘাত লাখো সিরীয়কে দেশ ছেড়ে পালাতে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলো এখন বিশ্বজুড়ে শরণার্থী ও অভিবাসীদের স্রোতকে ভয় বাড়িয়ে দেয়ার কাজে লাগাচ্ছে এবং নির্বাচনগুলোয় বিদেশি ভীতির প্লাটফর্মে লড়াই করতে ব্যবহার করছে।

জার্মানি ও ইতালির মতো দেশে তারা নির্বাচনী সফলতা পেয়েছেও এবং ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘ ও কঠোর লড়াই চালিয়েছেন মিডিয়ায় ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’ হিসেবে যা পরিচিতি পেয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য। বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বর্ণবাদী প্রতিবাদ-র‌্যালি অব্যাহত রয়েছে ইরাক যুদ্ধের বৈশ্বিক মানসিক আঘাতের কারণে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ইরাককে ‘স্বাধীন’ করার ব্যর্থ ও বিপর্যয়কর চেষ্টার পর বিশ্বজুড়ে জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা এখন যে কোনো ধরনের মধ্যস্ততা ও হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে অনিচ্ছুক। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না।

কারণ ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে রাজি নন কেউ। ইরাকের বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট এ মানসিকতা সিরিয়া সংকট সমাধানের বেলায় নৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি করেছে, যে সংঘাতে এখন পর্যন্ত কয়েক মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত ও কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বর্তমানে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এবং তার সমর্থক ইরান ও রাশিয়া দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আর বিশ্ববাসী কেবল তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে সেটা।

এসব বিষয় ইরাক যুদ্ধের একক ফল হিসেবে বেরিয়ে এসেছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি সহিংস ও অস্থিতিশীল। সৌদি আরব ও ইরান আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের এমন এক ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত যা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটার অবস্থানে আছে।

অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া বিশ্বমঞ্চে তাদের জোরালো অবস্থানের জানান দিচ্ছে এবং সাবেক এককেন্দ্রিক বিশ্বকে উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। আর ইউরোপ শরণার্থী সংকট থেকে জন্ম নেয়া বিদেশি ভীতির সঙ্গে সংগ্রাম করছে, যা প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতার ফল থেকে তৈরি।

গোটা বিশ্ব ইরাক যুদ্ধের প্রভাব উপলব্ধি করেছে। দেড় দশকের বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার পর একবিংশ শতাব্দীর জঘন্যতম পাপ ছাড়া ইরাক আগ্রাসনকে অন্য কোনো নামে বিশেষায়িত করা কঠিনই।

আলজাজিরা থেকে অনুবাদ: সাইফুল ইসলাম

তালহা আবদুলরাজাক: ইউনিভার্সিটি অব এক্সপার্ট’স স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটি ইন্সটিটিউটের গবেষক
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে