বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২৮:০৯

চীন-রাশিয়া ছাড়া মিয়ানমারের বিচার চায় সবাই

চীন-রাশিয়া ছাড়া মিয়ানমারের বিচার চায় সবাই

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ‘১৯৮৮ সালে হালাবজা, ১৯৯৫ সালে স্রেব্রেনিচা, ২০০৩ সালে দারফুর। সহিংসতার এই মর্মান্তিক তালিকায় এখন নতুন নাম যোগ হবে : ২০১৭ সালে রাখাইন।’ সুইডেনের পক্ষে দেশটির রাষ্ট্রদূত কার্ল স্কু এভাবেই রোহিঙ্গার প্রতি মিয়ানমার বাহিনীর নিপীড়ন ও গণহত্যার প্রসঙ্গ তুলেছেন নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত আলোচনায়। মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গললবার রাতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে পরিষদের প্রায় সব সদস্য রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার ও জবাবদিহির দাবি তোলেন। জাতিসংঘ মহাসচিবও মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। তবে আগের মতোই অনেকটা এক সুরে কথা বলেছে মিয়ানমার, চীন ও রাশিয়া। চীন-রাশিয়া ছাড়া মিয়ানমারের বিচার চায় সবাই। 

গত সোমবার জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী দল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার অভিযোগ তোলায় নিরাপত্তা পরিষদের ওই আলোচনাকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মিয়ানমারের এই দায় এড়ানোর চেষ্টা এবং চীন ও রাশিয়ার তাতে গলা মেলানোর নিন্দা করছেন মানবাধিকারকর্মী থেকে বিশেষজ্ঞরা।

মিয়ানমার জাতিসংঘ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বলে, তারা জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাব ও সত্যানুসন্ধানী দলকেই মানে না, অতএব এই দলের প্রতিবেদনও তারা প্রত্যাখ্যান করছে। উল্টো এই সত্যানুসন্ধান দল গঠনের উদ্দেশ্য ও যথার্থতা নিয়েই মিয়ানমার প্রশ্ন তোলে। আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশের মধ্যে ৮১টিই ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে মিয়ানমারের বানোয়াট দাবি তুলে ধরে ওই দেশটির পক্ষে সাফাই গেয়েছে রাশিয়া। চীনও রোহিঙ্গা সংকটকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, চাপ না দিয়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সংকট সমাধানে দুই দেশকে সহযোগিতা করা উচিত।

নতুন করে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বার্ষিকীর পর নিরাপত্তা পরিষদে গত মঙ্গলবার রাতের আলোচনায় পরিষদের সদস্যরা জোরালো ও আবেগঘন বক্তব্য দেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে যেসব ঘটনা শুনেছি তা আমি ভুলতে পারি না। একজন বাবা কান্নায় ভেঙে পড়ে আমাকে বলেছিলেন কিভাবে, তাঁরই সামনে তাঁর ছেলেকে গুলি করে মারা হয়েছে। তাঁদের যন্ত্রণা উপশম ও এই ট্র্যাজেডি থামানোর চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব।’ জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী দল মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর অপরাধ সংঘটনের যে তথ্য তুলে ধরেছে তাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতে গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অপরাধগুলোর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য জবাবদিহিতা কাঠামো নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সব অঙ্গসংগঠনের সহযোগিতা অপরিহার্য।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহযোগী প্রশাসক তেগেগনিঅর্ক গেট্টু রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান হবে না বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন এবং  মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দেন।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) শুভেচ্ছা দূত কেইট ব্লানশেট গত মার্চে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের যে করুণ অভিজ্ঞতা হয় তা তুলে ধরেন আলোচনায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্থানীয় সম্প্রদায় যদি সীমিত সামর্থ্য নিয়েই লাখ লাখ রোহিঙ্গার পাশে দাঁড়াতে পারে তবে সামর্থ্য থাকার পরও আমরা কেন পারব না?’ নিরাপত্তা পরিষদকে নিজ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে ব্লানশেট বলেন, ‘আমরা অতীতে ব্যর্থ হয়েছি। আর ব্যর্থ করবেন না।’ তিনি বলেন, বিশ্বের নিরাপত্তা বিষয়ে দেখভালের মূল দায়িত্বটি নিরাপত্তা পরিষদের। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল এটিই প্রথম নয়। সমস্যার সমাধান হয়নি বলেই অনেকে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ব্লানশেট জানান, তিনি রোহিঙ্গা শিবিরে গেলে লায়লা নামে এক রোহিঙ্গা মা শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে বলেন, যারা তাঁর স্বামীকে ধরে নেয়, তারাই পাঁচ দিন পর এসে বাড়িঘরে আগুন দেয়। লায়লা দেখেছেন কিভাবে তাঁর চাচাকে হত্যা করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের পক্ষে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী লর্ড আহমাদ বলেন, অপরাধ করে যাতে কেউ পার পেয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের সরকারও এই বিচারের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক কাঠামোর আওতায় বিচার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে। তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সাতজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ গত বছর সেপ্টেম্বর মাসেই রোহিঙ্গা নির্মূলের নিন্দা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচারের আওতায় আনতে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অপরাধের তথ্য-উপাত্ত ও আলামত সংগ্রহের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানায়।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিক্কি হ্যালি বলেন, ‘জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন ও সুপারিশ অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। এই প্রতিবেদনের পর মিয়ানমারের জন্য কঠিন সত্য এড়ানো কঠিন। তিনি জানান, রাখাইনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর দৃষ্টি রাখছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন কী করব তা সারা বিশ্ব দেখার অপেক্ষায় আছে।’

সুইডেনের রাষ্ট্রদূত বলেন, মিয়ানমার বাহিনীর নৃশংস অপরাধের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদ চোখ বুজে থাকতে পারে না।

পেরুর রাষ্ট্রদূত জোর দিয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানো ব্যক্তিরা যাতে দায় মুক্তি না পায় তা নিরাপত্তা পরিষদকে নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে আইভরি কোস্ট, পোল্যান্ড,  কাজাখস্তান, ইথিওপিয়া, বলিভিয়া ও ইকুয়েটোরিয়াল গিনির রাষ্ট্রদূত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার দাবি করেন। কুয়েতের রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জাতিগত নির্মূল চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেন।

রাশিয়া ও চীনের রাষ্ট্রদূতরা বলেন, এ সমস্যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের। দুই দেশের আলোচনার মাধ্যমেই এটি সমাধান হওয়া উচিত।

নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের নিজস্ব তদন্ত কমিশন প্রসঙ্গে বলেন, জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হলে উদ্যোগ অর্থবহ। মিয়ানমার ব্যর্থ হলে বিশ্ব সম্প্রদায়কেই দায়িত্ব নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইসিসিতে মিয়ানমারের অপরাধ তদন্ত ও বিচারে নিরাপত্তা পরিষদকে উদ্যোগ নিতে হবে।

অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাঁর সরকারের চেষ্টার কথা উল্লেখ করে বলেন, সন্ত্রাসী হামলার জবাবেই মিয়ানমার বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করেছে। বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সমর্থনে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাচ্ছে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ‘নিরপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বলেন, তাদের বিশেষ করে, নারী ও শিশুদের দুর্দশাকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনীতি করার সময় এটি নয়।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহকারীরা। ‘তুলাতলি গণহত্যার সাক্ষ্য’ নামে ডকুমেন্টারি নির্মাতা শফিউর রহমান বলেন, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা পরিষদে আনাড়ি অভিনেতার চোখের জল ফেলেছেন ও মিথ্যাচার করেছেন। ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সমন্বয়ক রো নে সান লুইন বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হলিউড অভিনেত্রী কেইট ব্লানশেটের মতো অভিনয়ে দক্ষতা দেখিয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক আইনের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মেলানি ও’ব্রায়েন টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘অবশেষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জোরালো আহ্বান দেখতে ভালো লাগছে। তবে চীন ও রাশিয়ার আগ্রহ বা অনাগ্রহের ক্ষেত্রে এটি হয়তো তেমন কোনো প্রভাবই ফেলবে না।’ ফ্রি রোহিঙ্গা সংগঠনের সমন্বয়ক মং জার্নি টুইট বার্তায় লেখেন, ‘মিয়ানমারে গণহত্যা চালানো শাসকদের হয়তো আগামীতে বিচার হবে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ এখন নিজেই বিচারের মুখোমুখি। সংকীর্ণ স্বার্থে মানবতাকে কম গুরুত্ব দিয়ে বিবাদ করা ছাড়া এই অঙ্গসংগঠনটির আদৌ কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আছে কি না বিশ্ব দেখছে।’ আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির এশিয়া প্যাসিফিক সম্পাদক জেরোমি টেলর বলেছেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের মধ্যে চীন ও রাশিয়া নিশ্চিতভাবেই হয়তো আইসিসিকে (আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মিয়ানমারের বিচারের উদ্যোগ) সমর্থন করবে না। তবে মিয়ানমার এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে একঘরে হয়ে গেছে।’
এমটিনিউজ২৪.কম/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে