সোমবার, ০৪ মার্চ, ২০১৯, ১১:৪৫:৩৫

কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন

কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন

মেহেদী হাসান : কাশ্মীরকে বলা হয়ে থাকে ভূস্বর্গ। কিন্তু সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি মানুষসৃষ্ট রাজনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এই ভূখণ্ডে বসবাসরত নাগরিকদের জনজীবন ব্যাহত হয়েছে কখনও বা রাইফেলের গুলিতে, আবার কখনও বোমার আঘাতে। সর্বশেষ যে ঘটনাটি আবারও কাশ্মীরকে নাড়া দিল সেটি ঘটেছে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি।

কাশ্মীরের ভারতশাসিত পুলওয়ামায় আদিল আহমেদ দার নামের এক যুবকের আত্মঘাতী হামলায় ৪৯ জন ভারতীয় সেনা মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের স্বাধীনতার পর এটাই সবচেয়ে বড় সেনা প্রাণহানির ঘটনা। জইশ-ই-মুহাম্মদ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এ ঘটনার পর শুরু হয়েছে জঙ্গিবিরোধী অভিযান, চলছে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা।

পৃথিবীর ছোট-বড় প্রায় প্রতিটি দেশই সমস্বরে ভারতের পাশে থেকে এ সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করতে চেয়েছে। যেহেতু পৃথিবীর এই মুহূর্তের সবেচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাস, তাই এটাকে যে কোনোভাবে প্রতিহত করতে হবে। এ দাবিতে সোচ্চার জাতিসংঘের প্রায় প্রতিটি সদস্য দেশ। বরাবরের মতন চলছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। এবার ঘটনাটিকে নাটকীয় মোড় দিতে প্রথম থেকেই সব চেষ্টাই করছে দুটি দেশ।

ভারত এবার নাটকের প্রথম দৃশ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর তিনটায় পাকিস্তানে বিমান হামলা করে, ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এই হামলায় প্রায় ৩০০ জঙ্গি নিহত হয়েছে এবং এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানও পরবর্তী সময়ে সীমান্তে কিছু গুলিবর্ষণ করেছে। 

চলছে দীর্ঘ সাত যুগ ধরে চলে আসা কাশ্মীরিদের স্বাধিকার আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদ নাম দেয়ার নাটকের নতুন পর্ব। নাটকের পরিচালক ভারত ও পাকিস্তান, দর্শক জাতিসংঘসহ পৃথিবীর সব ছোট-বড় মানবাধিকার সংগঠনগুলো আর নাটকের মঞ্চ কাশ্মীর ও এর নিরীহ জনগণ।

ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর সমস্যার বীজ বপন করেছিল ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। ইতিহাস অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়, সৌন্দর্যের লীলাভূমি কাশ্মীর কোনোদিনও ভারত বা পাকিস্তানের অংশ ছিল না। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার আগে থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের সূচনা।

‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান- যে কোনো রাষ্ট্র্র্রেই যোগ দিতে পারবে।

কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দেয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ- যা চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়। কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে, তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। 

তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তার চিঠি ও ভাষণে বহুবার বলেছেন, কাশ্মীরের মালিক কাশ্মীরের জনগণ। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, তারা কাদের সঙ্গে থাকতে চায়।

১৯৫৫ সালের ৩১ মার্চ লোকসভায় দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘কাশ্মীর কোনো বিনিময়ের বস্তু নয়, যা ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। বরং কাশ্মিরের প্রাণ রয়েছে, তার পৃথক সত্তা রয়েছে। কাশ্মীরি জনগণের সদিচ্ছা এবং মতামত ছাড়া কিছুই করা যাবে না।’ 

ঐতিহাসিক বাস্তবতা হল, নেহেরুর রাজনৈতিক অবস্থান পরবর্তীকালে কার্যকর হতে দেখা যায়নি ভারতের রাষ্ট্র্র্রীয় নীতিতে। কাশ্মীরিদের গণভোটের আশ্বাস দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং দিনকে দিন কাশ্মীর পরিবেষ্টিত হয়েছে লাখ লাখ সেনা সদস্যের দ্বারা, হয়ে উঠেছে ভারত-পাকিস্তানের পরোক্ষ যুদ্ধের এক ক্ষেত্রে। তাতে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ।

অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চীন কাশ্মীরের আকশাই-চীন অংশটির নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, আর তার পরের বছর পাকিস্তান-কাশ্মিরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন- এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। 

দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে, এর পর আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এর পর ১৯৭১-এর তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তির মধ্যে দিয়ে বর্তমানের ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণরেখা চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে- যা নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে চিহ্নিত নয়। 

তা ছাড়া ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বাহিনী আরেকটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তিক্ত লড়াইয়ে জড়ায় পাকিস্তান-সমর্থিত বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে। ১৯৯৯-এর সেই ‘কারগিল সংকটের’। স্বাধীনতার দাবিতে সাধারণ কাশ্মীরিরা সোচ্চার হতে শুরু করে আশি দশকের পরপরই, এ ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়েছে ভারতীয় দখলদার সেনাবাহিনী, প্রতিনিয়ত অত্যাচার তাদের বাধ্য করেছে- মারি নয় মরি অবস্থা গ্রহণ করতে।

কাশ্মীরে বিদ্রোহী তৎপরতা বড় আকারে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর জেকেএলএফ নামে সংগঠনের উত্থানের মধ্য দিয়ে। ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে- তবে পাকিস্তান তা অস্বীকার করে। এই রাজ্যে ১৯৮৯ সালের পর থেকে সহিংস বিদ্রোহ নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে। 

১৯৯০ সালের পর সেনাবাহিনীর অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কাশ্মীরের ভারত ও পাকিস্তানের উভয় অংশেই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক- সব ক্ষেত্রেই রয়েছে চরম অশান্তি। এগুলো নিয়ে কোনো দেশই তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি।

সেই ১৯৪৮-এ যে গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তা আজও হয়নি। বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে জাতিসঙ্ঘের অপারগতা ও নীরবতা। কাশ্মীরিদের মানবাধিকার রক্ষার্থে তাহলে কি পৃথিবীর কেউ কোনো ভূমিকা পালন করবে না? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে পৃথিবীর বড় বড় মানবাধিকার সংস্থাকে। কাশ্মীরিদের ওপর হয়ে যাওয়া অত্যাচারগুলো কি মানবাধিকার হরণ নয়? 

কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ, যারা কাশ্মীর উপত্যকা, জম্মু, শ্রীনগর, লাদাখ এবং আজাদ কাশ্মীরে বসবাস করছে, তাদের কথা তো কেউ কখনও বলছে না। তারা আসলে কী চায় এই প্রশ্নটুকুও কেউ করছে না। যে স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য তারা এই চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে বা হামলার শিকার হচ্ছে, সেই স্বাধিকারকে অস্বীকার করার অধিকার কারও নেই।

যে ভারত বা পাকিস্তান আজ কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে নাটক মঞ্চায়িত করছে, সেই ভারত ও পাকিস্তানকে ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতার ঘানি টানতে হয়েছিল। স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের মূল্য তাদের সবচেয়ে ভালো বোঝার কথা। তাহলে কী করে এই দুটি জাতি আরেকটি জাতিগোষ্ঠীর স্বাধিকারকে এভাবে দুমড়ে-মুচড়ে নিঃশেষ করতে পারে? - যুগান্তর

মেহেদী হাসান : সহকারী অধ্যাপক, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে