আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলমান জনসংখ্যার দেশ ভারত। কিন্তু দেশটিতে সেই তুলনায় এ সম্প্রদায়টির ভেতর থেকে আইনপ্রণেতাদের সংখ্যা একেবারে কম। তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
বিহারের পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি লোকসভার আসন মাধুবানীতে কোন উষ্ণ সকাল। চিপা গলির ভেতর শাকিল আহমেদের আশপাশে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী, ব্যবসায়ী ও কর্মীরা জড়ো হয়েছেন।
কিছুক্ষণ পরেই তার সাদা মোটরসাইকেলের শোভাযাত্রা ধুলা উড়িয়ে ঢুকে পড়েছে একটি সরু গলিতে। লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক আক্রমণ-পাল্টা-আক্রমণের তুমুল প্রচার চলছে তখন।
৬৩ বছর বয়সী শাকিল আহমেদ দেশটির প্রধানবিরোধী দল কংগ্রেসের একজন সাবেক সদস্য। কিন্তু মাধুবানি আসনে গত এপ্রিলে তাকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেনি তার দল। কাজেই আবেগতাড়িত হয়ে তাকে এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
এক দশক কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িত থাকার পর দল থেকে তিনি পদত্যাগ করলেন। পরবর্তীতে একই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন এ রাজনীতিবিদ। এর আগে এ আসন থেকে দুইবার লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
এটা ছিল চমকে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত। এতে মুসলমানদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন তিনি। ভারতের এ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টির মধ্যে যে বিরক্তি ও হতাশা, তার বহির্প্রকাশ বলা যায় এ ঘটনাকে। পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছোট হয়ে আসা নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন দেশটির মুসলমানরা।
চলমান লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি(বিজেপি) সাতজন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে। লোকসভার ৫৪৫টি আসনের ৪৩৭টিতে প্রার্থী দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও একই সংখ্যক মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল দলটি।
কিন্তু তাদের কেউ শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে যেতে পারেননি। ভারতের ইতিহাসে পার্লামেন্টে এই প্রথম কোনো সরকারের মুসলমান প্রতিনিধি নেই।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ৪৬৪টি আসনে লড়েছে কংগ্রেস। কিন্তু তাদের মুসলমান প্রার্থী ছিল মাত্র ৩১জন। তাদের থেকে জয়ী হয়েছেন মাত্র সাতজন। এ নির্বাচনেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এবার ৪২৩ প্রার্থীর মধ্যে ৩২ মুসলিম প্রার্থী রয়েছেন।
শাকিল আহমেদকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেয়নি কংগ্রেস। যা সবাইকে বিস্মীত করেছে। যদিও দলটির একজন জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত তিনি। শাকিল কোনো সাধারণ প্রার্থী না। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তিনি কনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বাবা-দাদা দুজনেই কংগ্রেস নেতা এবং বিহার লোকসভার আইনপ্রণেতা ছিলেন।
বিহারের সামাজিক-ধর্মীয় সংগঠন ইমারাত শারিয়াহর মহাসচিব মাওলানা আনিসুর রহমান কাশেমি বলেন, শাকিল আহমেদের মতো একজন বড় কংগ্রেস নেতা কেবল নিজের আসনটি চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে সে আসন থেকে বঞ্চিত করায় তিনি এখন সাহস দেখিয়েছেন।
তিনি বলেন, কিন্তু অনেক আগেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল তার। কেবল মুসলমানরাই কংগ্রেসকে বিজয়ী করতে পারেন। এটা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কংগ্রেস মুসলমানদের ভোট চায়, কিন্তু তাদের কোনো টিকেট দিতে চায় না।
নিজেদের ধর্ম নিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ইতিহাস আছে কংগ্রেসের। দলটি সংখ্যালঘুদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপি থেকে তাদের ফারাক এখানেই। বিহার থেকে একশ ২০ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে কেবল আটজন মুসলমান।
গত মাসে একটি চিঠিতে জ্যেষ্ঠ মুসলিম কংগ্রেস নেতা শোয়াইব ইকবাল, মার্টিন আহমেদ, হাসান আহমেদ ও আসিফ মোহাম্মদ খান নয়াদিল্লিতে কোনো মুসলমান প্রার্থী না থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দলীয় সভাপতি রাহুল গান্ধীকে। রাজধানী থেকে অন্তত একটি আসনে হলেও মুসলিম প্রার্থী রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
চিঠিতে তারা বলেন, মুসলমান ভোটাদের দিকে তাকিয়ে, মুসলমান প্রার্থীদের জয় ও দলে তাদের অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে নয়াদিল্লি কিংবা উত্তর-পূর্ব দিল্লির পার্লামেন্টারি আসন থেকে অন্তত একটিতে মুসলমান প্রার্থী দিতে হবে।
কিন্তু রাহুল গান্ধী তাদের সেই আবেদনের কোনো মূল্য দেননি। নয়াদিল্লিতে প্রার্থী তালিকায় কোনো মুসলমানকে রাখা হয়নি। টিকেট দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়েছে কংগ্রেস।
দলটির জাতীয় গণমাধ্যম সমন্বয়ক সঞ্জিব সিং বলেন, তাদের যেখানে টিকিট দেয়া সম্ভব, আমরা দিয়েছি। ২০১৪ সালের তুলনায় এবার তাদের আমরা বেশি আসনে প্রার্থী করেছি। এছাড়া জোট রাজনীতির চাপও আমাদের ওপর রয়েছে।
ভারতে এসময়ে মুসলমান রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব একটু বেশিই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ১৯৮১ সালে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছয় কোটি ৮০ লাখ। কিন্তু ২০১১ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ২০ লাখে।
কিন্তু সেই তুলনায় মুসলমান জনপ্রতিনিধির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৯৮০ সালে যেখানে ছিল ৪৯জন, সেখানে সেই সংখ্যা কমে ২০১৪ হয়েছে ২২জন। ১৯৮০ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব ছিল নয় শতাংশ।
কিন্তু ২০১৪ তা কমে হয়েছে চার শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা ও পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্বের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে বর্তমানে ১০ থেকে দুই শতাংশ হয়েছে। গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে এই ব্যবধান বেড়েছে।
এই সংখ্যাগত সন্দেহটা হঠাৎ করে জাগেনি। ২০১৪ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিধস বিজয়ে দেশটির হিন্দুত্ববাদে জোয়ার লেগেছে। মুসলিম কর্মীরা বলেন, তাদের বড় অভিযোগ কংগ্রেসের প্রতি। দলটি তাদের প্রার্থী করতে অস্বীকার করছে।
ইউনাইটেড মুসলিম পলিটিক্যাল ইমপাওয়ারম্যান্টের সদস্য মুশতাকিম সিদ্দিকী বলেন, তারা মুসলমানদের মানসিকতায় বিজেপির ভয় ঢুকিয়েছে। এতে তারা যদি আমাদের একটি আসনেও প্রার্থী না করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা টু শব্দটি করবে না।
তিনি বলেন, মুসলমান প্রার্থীদের টিকিট না দেয়ার পরেও কংগ্রেস তাদের কাছে ভোট প্রার্থনা করে যাচ্ছে।
‘তারা আমাদের বলছেন, মুসলমানদের যে আসনটিতে টিকিট দেয়া হবে, সেটিতে ভোটের মেরুকরণ ঘটে যাবে,’ বললেন সিদ্দিকী। ‘মুসলমানদের সন্তুষ্ট করায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই, এমনটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে কংগ্রেস।’
এছাড়া কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গতিবেগকে অবহেলা ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর বিভাজনের জন্যও তাদের প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য দায়ী।
সেন্টার ফর দ্যা স্টাডি অব ডেভলপিং সোসাইটিজের রাজনৈতিক ইসলামের অধ্যাপক হিলাল আহমেদ বলেন, ইসলামে কোনো বর্ণপ্রথার আশ্রয় নেই। মুসলমানদের কেবল একটি একক রাজনৈতিক পরিচয় আছে। এটা খুবই হাস্যকর ভাবনা যে সামগ্রিকভাবে ভোট দিয়ে তারা ভোটব্যাংকের রাজনীতিকে পরাজিত করতে চাচ্ছেন।
ভারতীয় মুসলমানদের দাবি, তারা কেবল নিজেদের স্বার্থগত বিষয়গুলো আমলে নিয়েই ভোট দেন না।
মাধুবানি আসনের মোহাম্মদ কাদরি নামের এক বাসিন্দা বলেন, সবাই ভালো সড়ক, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ভালো চাকরি চায়। কিন্তু তারা এসবগুলোকে ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে ফেলে।
‘শাকিল আহমেদ এখানে ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু কেবল মুসলমান পরিচয়ের কারণে তাকে প্রার্থী করেনি কংগ্রেস। এমন সিদ্ধান্ত একেবারেই ভুল।’
তিনি বলেন, আমরা বিজেপির কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করছি না। কিন্তু কংগ্রেসের কাছে ভরপুর প্রত্যাশা আছে।
কিন্তু এখনো মুসলমান ধর্মীয় নেতারা কংগ্রেসের জন্য ভোট প্রার্থনা করছেন। কারণ তাদের কাছে মনে হয়েছে, এর বাইরে তাদের আর কোনো বিকল্প নেই।
মাওলানা কাসেমি বলেন, আমরা যেন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক, যাদের কৌশলগতভাবে চলে যাওয়ায় কোনো বাধা নেই। কিন্তু আমাদের চলে যাওয়ার কোনো পথও খোলা নেই।
তিনি বলেন, একটি সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু আমাদের তরুণদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তারা শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত। কাজেই চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের মতো আমরা তাদের ভোট দিয়ে যাচ্ছি, যেমনটা আমাদের পূর্বসূরিরা করেছেন।
২০১৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার জ্যাফরেলট বলেন, পার্লামেন্টে আপনাদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো লোক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমনটা না-ই ঘটে তবে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়ার মতো কোনো লোক থাকবে না।
ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান সংখ্যালঘুদের হয়ে কতটুকু কথা বলা হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করেন জ্যাফরেলট। দাঙ্গা, মুসলিম পারিবারিক আইন ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন এবং বিতর্ক নিয়ে গবেষণা করেন তিনি।
মাধুবানির সমাজকর্মী আতাউর রহমান আনসারি বলেন, পার্লামেন্টে এমন লোক দরকার, যারা আমাদের হয়ে সংসদে কথা বলবেন। আমাদের তাঁতিদের ঘর থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। তারা কাজের খোঁজে মুম্বাই যাচ্ছেন। কাজেই নির্বাচনে আমাদের থেকে যদি প্রার্থীই না করা হয়, তবে পার্লামেন্টে আমাদের হয়ে কে কথা বলবেন?
কাজেই প্রান্তিকীকরণের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের জন্য ভারতীয় মুসলমানরা এখন নতুন উপায় খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এ বছরের মার্চে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, মুসলমান ভোটাররা কংগ্রেসের মোহ থেকে মুক্তি চাচ্ছেন। চলতি লোকসভা নির্বাচনে কর্ণাটক, পশ্চিমবাংলা ও রাজস্থানে মুসলমানরা বিজেপিকে ভোট দিতে যাচ্ছেন।
শাকিল আহমেদের মতো প্রার্থীরা কংগ্রেসের ছেড়ে আলাদাভাবে নির্বাচন করে মুসলমানদের জন্য প্রতিনিধিত্ব করতে চাচ্ছেন। নতুন নেতৃত্ব আসবে বলে আশায় বুক বেঁধে আছেন ভারতীয় মুসলমানরা, যারা কেবল মুসলমানদের জন্যই না, ভবিষ্যতে গোটা ভারতের নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
মাওলানা কাসেম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো উদারহস্তে যা দেয়, মুসলমানদের কেবল সেই দানের ওপর নির্ভর করে বসে থাকা উচিত না। এখন আমাদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার সময়। মুসলমান নেতাদের সাহস ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কেবল মুসলমান সম্প্রদায়ই না, পুরো দেশের নেতৃত্ব নেয়ার সময় এসেছে তাদের। -বিবিসি