সোমবার, ২০ মে, ২০১৯, ০৬:১৬:১৫

বিয়ের আসরে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সামনে খেতে বসায় যুবককে হত্যা

বিয়ের আসরে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সামনে খেতে বসায় যুবককে হত্যা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রত্যন্ত এক ভারতীয় গ্রাম কটে গেলেই টের পাওয়া যায় সেখানকার দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো কতটা ক্ষোভ আর অসহায়ত্ব।

গত মাসে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সেখানে ২১ বছরের এক দলিত যুবক জিতেন্দ্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে বলে অভিযোগ। এর নয় দিন পরে জিতেন্দ্র হাসপাতালে মারা যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক বিয়ের অনুষ্ঠানে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের উপস্থিতিতে টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন।

সে দিনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যে কয়েক শো অতিথি যোগ দিয়েছিলেন, তাদের একজনও বলতে রাজি হননি গত ২৬ এপ্রিল সেখানে কী ঘটেছিল। রোষের শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কায় তারা কেবল এটুকু বলছেন যে বিয়ের ভোজ হচ্ছিল যে বিরাট মাঠে, তারা কেবল সেখানে হাজির ছিলেন। 

কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কেবল পুলিশই প্রকাশ্যে কিছু বলছে। ওই বিয়ের অনুষ্ঠানের খাবার রান্না করা হচ্ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দিয়ে। কারণ এরকম প্রত্যন্ত এলাকায় দলিতদের রান্না বহু মানুষ স্পর্শই করবে না।

ভারতে হিন্দুদের মধ্যে যে কঠোর বর্ণ প্রথা, সেখানে দলিতদের অবস্থান সবার নিচে। পুলিশ অফিসার অশোক কুমার জানান, 'যখন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল সেখানে গণ্ডগোল শুরু হয়। চেয়ারে কে বসেছে, তা নিয়ে শুরু হয় বিতণ্ডা।'

ভারতে নিপীড়নের শিকার নিম্নবর্ণের মানুষদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য যে আইনটি আছে, (সিডিউলড কাস্ট অ্যান্ড সিডিউলড ট্রাইবস, প্রিভেনশন অব এট্রসিটিস এক্ট), সেই আইনে এই ঘটনায় মামলা রুজু হয়।

ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অস্পৃশ্য বলে গণ্য করে। তারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে বহু শত বছর ধরে নিপীড়ন এবং অবমাননার শিকার। এ ধরণের আচরণ এখনো অব্যাহত। দলিতরা যখন সমাজে ভালো কোন অবস্থানে পৌঁছার চেষ্টা করে, সেটিও সহিংস উপায়ে থামিয়ে দেয়া হয়।

পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজারাটে এ মাসেই দলিতদের চারটি বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা করা হয়। অতি তুচ্ছ অজুহাতে দলিতদের ওপর হুমকি, হামলা, মারধোর বা তাদের হত্যা করা এখনো নিয়মিতই ঘটে।

ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তরখণ্ডের কট গ্রামেও পরিস্থিতি একই রকম। দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, সেদিন বিয়ের অনুষ্ঠনে জিতেন্দ্রকে অপমান করে মারধোর করা হয়।

তারা আরও জানাচ্ছেন, কাঁদতে কাঁদতে তিনি বিয়ের অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুদূর যেতেই আবার তার ওপর হামলা চালানো হয়। এবার পেটানো হয় আরও ভয়ানকভাবে।

জিতেন্দ্রর মা গীতা দেবি পরদিন সকালে দেখতে পান তার ছেলে গুরুতর আহত অবস্থায় ঘরের বাইরে পড়ে আছে। 'সারারাত ধরে হয়তো সে ওখানে পড়ে ছিল। ওর সারা শরীরে মারের দাগ ছিল। ও কথা বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছু বলতে পারছিল না।'

গীতা দেবি জানেন না কে তার ছেলেকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। নয় দিন পর হাসপাতালে মারা যান জিতেন্দ্র। জিতেন্দ্র ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্কুল ছেড়ে অল্প বয়সে তাকে কাজে নেমে পড়তে হয়েছিল।

পরিবারের লোকজন এবং বন্ধুদের ভাষ্য অনুযায়ী জিতেন্দ্র ছিলেন বেশ চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ, কথা বলতেন কম। এই ঘটনার বিচার দাবি করছেন তার প্রিয়জনরা, কিন্তু সমাজের কাছ থেকে সে রকম সমর্থন তারা পাননি।

'এখানে অনেক ভয়। পরিবারটি থাকে একটি প্রত্যন্ত এলাকায়। তাদের কোন জমি নেই। তাদের অবস্থা বেশ নাজুক,' বলছেন দলিত উন্নয়ন কর্মী জবর সিং ভার্মা। 'আশে-পাশের গ্রামগুলোতে দলিতদের তুলনায় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সংখ্যা অনেক বেশি।'

জিতেন্দ্রের গ্রামে ৫০টি পরিবারের মধ্যে দলিত পরিবারের সংখ্যা ১২/১৩টি। উত্তরখণ্ড রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ হচ্ছে দলিত। এই রাজ্যে দলিতদের বিরুদ্ধে এরকম সহিংসতার অনেক ইতিহাস আছে। 

এই ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু তাদের সবাই এ ঘটনার দায় অস্বীকার করেছে। 'এটি আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র', বললেন এক নারী, যার বাবা, চাচা এবং ভাইদের এই ঘটনায় আসামি করা হয়েছে। 'আমার বাবা কেন দলিতদের কোন বিয়েতে গিয়ে জাত তুলে গালি দিতে যাবেন?'

আরেকজন ইঙ্গিত করলেন জিতেন্দ্র হয়তো বেশি ওষুধ খেয়ে মারা গেছেন। 'ও হয়তো মার খেয়ে বেশ লজ্জিত বোধ করছিল, তারপর হয়তো অনেক বড়ি খেয়ে ফেলেছিল। সেটা থেকেই হয়তো ও মারা গেছে।'

কিন্তু দলিত গ্রামের লোকজন এসব কথাবার্তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, জিতেন্দ্র মৃগী রোগী, কিন্তু বেশি মাত্রায় ওষুধ খেয়ে জিতেন্দ্র মারা গেছেন, এটা হতেই পারে না। তবে জিতেন্দ্রর মৃত্যু নিয়ে যতই ক্ষোভ থাক, গ্রামের মানুষ এখনো পর্যন্ত নীরবই আছেন।

সমাজকর্মী দৌলত কানওয়ার বলেন, 'এর কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ দলিত ভূমিহীন। তারা উচ্চবর্ণের ধনী হিন্দুদের জমিতে কাজ করে। যদি এ ঘটনা নিয়ে বেশি কথা বলে তার পরিণাম কী হবে সেটা তারা জানে।'

গীতা দেবে বলেন, সত্য ধামা চাপা দেয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। কিছু লোক আমাদের বাড়িতে এসে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। আমাদের পক্ষে কোন লোক নেই। কিন্তু আমি এই ঘটনার বিচার না নিয়ে ছাড়বো না।'

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে