সোমবার, ০৫ আগস্ট, ২০১৯, ০৮:২৩:৫০

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী পরিচয় ধ্বংস করতেই ৩৭০ ধারা বিলোপ!

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী পরিচয় ধ্বংস করতেই ৩৭০ ধারা বিলোপ!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ, যা কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়, তা বিলোপ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। ওই ধারা বিলোপ করার বিষয়টি বিজেপি'র পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর একটি।

স্বাধীনতা লাভের সাত দশক পর ভারতে বিজেপি সরকার অবশেষে তাদের বহু পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাটি বাস্তবায়ন করল। দলটি ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করেছে যার মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হতো। এর মধ্য দিয় কাশ্মীরের স্বায়ত্ত্বশাসন বাতিল করা হলো।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের 'ডেমোগ্রাফি' বা জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলে দেওয়াই কি সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য? এ বিষয়টি নিয়ে এখন তীব্র বিতর্ক দানা বাঁধছে। ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বা তাদের পুরনো সংগঠন জনসঙ্ঘ অবশ্য বহু বছর ধরেই ভারতীয় সংবিধানের এই বিতর্কিত ধারাটি বিলোপ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। 

বিজেপির বক্তব্য ছিল, কাশ্মীর যাতে সম্পূর্ণভাবে ভারতের সাথে সংযুক্ত বা 'আত্মীকৃত' হতে পারে সে জন্যই এই ধারাটি বিলোপ করা দরকার। স্বাধীনতার সাত দশক পর ভারতের সরকার বিজেপির এই বহু পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাটি বাস্তবায়ন করল। পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্-র নাটকীয় ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বুঝিয়ে দেয়, তারা এই পদক্ষেপের মধ্যে অন্য অভিসন্ধি দেখছে। 

রাজ্যসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ তৃণমূলসহ অন্য কিছু বিরোধী লকে পাশে নিয়ে ঘোষণা করেন, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীরের যে অনন্য চরিত্র, কলমের এক খোঁচায় বিজেপি সেটাই বরবাদ করে দিতে চাইছে।

তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে সীমান্তবর্তী রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর এমন একটি প্রদেশ, যার সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি সবই বাকি দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এই রাজ্যের লাদাখে বৌদ্ধ ও মুসলিমরা থাকেন, কাশ্মীরে থাকেন মুসলিম, পন্ডিত ও শিখরা। আর জম্মুতে জনসংখ্যার ষাট শতাংশ হিন্দু, আর বাকি চল্লিশ শতাংশ মুসলিম।

তিনি বলেন, এমন একটি রাজ্যকে এক সূত্রে বেঁধে রাখতেই ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। এই ধারায় রাজ্যের সব ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষের জন্যই বিশেষ ব্যবস্থা ছিল যা আজ বিজেপি শেষ করে দিল। ভারতশাসিত কাশ্মীরের সাবেক এই মুখ্যমন্ত্রী যে কথাটা কিছুটা রাখঢাক করে বলছেন, কাশ্মীরি অ্যাক্টিভিস্টরা সেটাই বলছেন আরও খোলাখুলি।

তারা বলছেন, এর মাধ্যমে কাশ্মীর উপত্যকা বা ভ্যালির ডেমোগ্রাফি বদলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কাশ্মীরের বারামুলা কলেজে এক সময় অধ্যাপনা করেছেন নাজির আহমেদ শল। কাশ্মীরিদের 'সেলফ ডিটারমিনেশন' বা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে তিনি গত বহু বছর ধরে লন্ডনে আন্দোলন চালাচ্ছেন।

লন্ডন-ভিত্তিক জাস্টিস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অধ্যাপক শল বলছেন, ৩৭০ ধারা বিলোপের আগেই অন্তত দুটি পদক্ষেপ থেকেই পরিষ্কার আঁচ করা যাচ্ছিল বিজেপি সরকার কাশ্মীরের আবহমান কালের চরিত্রটা পাল্টে দিতে চাইছে।

তিনি বলেন, প্রথমত ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল কাশ্মীরের জন্য যে 'ডোভাল ডকট্রিন' ফর্মুলেট করেছিলেন তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাই ছিল ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে লোকজনকে কাশ্মীরে এনে বাস করানো।

যেমন, ওই ডকট্রিনে কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের জন্য আলাদা কলোনি স্থাপন, কাশ্মীরে শিল্পাঞ্চলের জন্য বাকি ভারত থেকে শিল্পশ্রমিকদের এনে বসতি গড়া কিংবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের এনে কাশ্মীরে জমি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। 

তিন বলছেন, দ্বিতীয়ত, বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও আর্টিকল ৩৫এ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি তারা সরাসরি ঘোষণা দিয়েছিল বিজেপিকে ভোট দিয়ে জেতালে কাশ্মীরে জমিজমা কিনতে পারবেন আনায়াসেই।

অধ্যাপক শলের বলতে কোনও দ্বিধা নেই, আজকের পদক্ষেপ আসলে একটি সাংবিধানিক সন্ত্রাসবাদ যার মাধ্যমে কাশ্মীরের স্বকীয় পরিচিতি বা আইডেন্টিটি ধ্বংস করে ডেমোগ্রাফিক রিইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিজেপি গত নির্বাচনের আগে পোস্টার দিয়েছিল, 'ঠিকঠাক ভোট দিলে আপনার ভোট কিন্তু আপনাকে কাশ্মীরে জমির প্লটও এনে দিতে পারে।'

বস্তুত ৩৭০ ধারা বিলোপের সমর্থনে বিজেপি ঠিক এই যুক্তিটাই দিচ্ছে যে, এতদিনে কাশ্মীর ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের সঙ্গে সমান কাতারে এলো, কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সম্পূর্ণ হলো।

বিজেপির তাত্ত্বিক নেতা ও পলিসি রিসার্চ সেলের নেতা অনির্বাণ গাঙ্গুলির কথায়, জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি আজ থেকে ছেষট্টি বছর আগে কাশ্মীরের সর্বাত্মক ভারতভুক্তির জন্য যে ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবি জানিয়েছিলেন, আজ তার রাজনৈতিক উত্তরসূরীরাই সেই স্বপ্নকে পূরণ করলেন। আর ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের কথা যারা বলছেন, সেটা এই পটভূমিতে সম্পূর্ণ অবান্তর।

তিনি বলেন, ৩৭০ ধারা এতদিন ছিল বলেই কাশ্মীরে যারা তফসিলি জাতি বা উপজাতিভুক্ত, কিংবা অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণীর তারা বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। কেন শুধু কাশ্মীরে বসবাস করার জন্য এই মানুষগুলো দিনের পর দিন ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবেন? আর এটা তো ভারতীয় সংবিধানেরও পরিপন্থী - কাজেই এটা অ্যাড্রেস করতেই হতো। 

বিজেপি দাবি করছে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্তির মধ্যে দিয়ে ভারত-শাসিত ওই প্রদেশের সোয়া কোটিরও বেশি মানুষ অবশেষে বাকি দেশের সঙ্গে সমানাধিকার পেল এবং একই মূল ধারায় মিশতে পারল বলে। 

তবে এই পদক্ষেপের বিরোধীরা মনে করছেন, এর মধ্যে দিয়ে আসলে কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি তুলে নিয়ে উপত্যকার দরজা খুব সচেতনভাবে খুলে দেওয়া হলো ভারতের সব বর্ণ-ধর্ম-ভাষার মানুষের জন্য। 

তারা মনে করছেন, ইসরায়েল একদিন যা ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত অঞ্চলে করেছে অথবা চীনও করেছে তিব্বতে। সুন্নি মুসলিমগরিষ্ঠ কাশ্মীরে ভারতও ঠিক সেই একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে