আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাত কেটে গিয়ে ভোর হতে না হতেই শ্রীনগরের আকাশে-বাতাসে যেন একটা গুমোট ভাব ছড়িয়ে পড়িয়েছিলো আজ বৃহস্পতিবার। এক অশুভ নীরবতার মধ্যেই শহরের মসজিদগুলো থেকে ভেসে আজানেরও ধ্বনিও যেন আতঙ্কিত মানুষের হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।
গত ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ভারতীয় সেনা ও কাশ্মীরের বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ইনশা আশরাফ নামের এক ২৬ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীর প্রসব বেদনা শুরু হয়। তার গর্ভের পানি ভেঙে যায়।
শ্রীনগরের শহরতলীতে বেমিনা এলাকায় নিজের মায়ের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন ইনশা। কিন্তু নিজের প্রথম সন্তানটি ঠিকমতো প্রসব করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে আত'ঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
ইনশার প্রসব বেদনা ওঠার পরপরই তার মা মুবিনা তাকে তাদের প্রতিবেশি অটোরিকশা চালকের বাড়িতে নিয়ে যান ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে। ওই অটোরিকশা চালক ইনশাকে ৭ কিলোমিটার দূরের লাল দেদ হাসপাতালে নিয়ে যেতে রাজি হন। কিন্তু রাস্তায় নেমে কয়েকমিটার যাওয়ার পরপরই সেনা চেক পয়েন্টে তাদের আটকে দেওয়া হয়।
ইনশা বলেন, ‘আমি তাদেরকে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টি বুঝিয়ে বলি। কিন্তু তারা আমাদেরকে যেতে দিতে রাজি হয়নি। এরপর সেনারা আমাদেরকে ভিন্ন কোনো পথ দিয়ে হাসপাতালে যেতে বলেন।’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমরা হাসপাতালের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করি। রাস্তায় প্রতি ৫০০ মিটার পরপরই আমরা ভারতীয় সেনা চেকপয়েন্টের মুখোমুখি হচ্ছিলাম। প্রতিটি চেকপয়েন্টেই সেনারা আমাদেরকে ভিন্নপথ ধরে হাসপাতালে যেতে বলে।’
বেলা ১১টার দিকে তারা যখন লাল দেদ হাসপাতাল থেকে ৫০০ মিটার দূরে ছিলো তখনই ইনশার প্রসব বেদনা তীব্রভাবে বেড়ে যায়। ইতিমধ্যেই ইনশা প্রসব বেদনা সহই ৬ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এসেছেন। ফলে রাস্তার পাশেই তার বাচ্চা প্রসব হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে তার মা তাকে পাশের খানামস নামের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান।
ওই হাসপাতালে পৌঁছার ১৫ মিনিটের মধ্যেই ইনশা একটি স্বাস্থ্যবান কন্যা সন্তান প্রসব করেন। প্রসবের পর বাচ্চাটিকে নগ্নভাবেই ডেলিভারি রুম থেকে বের করতে বাধ্য হন তারা। কেননা পুরো উপত্যকাজুড়ে অচলাবস্থার কারণে হাসপাতালে কোনো কাপড় ছিলো না তাদেরকে দেওয়ার মতো।
ইনশার মা মুবিনা বলেন, ‘নাতনিকে আমি আমার ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে কোলে নেই। ইতিমধ্যে ইনশার বোন নিশা হাসপাতালের বাইরে গিয়ে ১ ঘন্টা চেষ্টা করার পর নবজাতকের জন্য কিছু কাপড় ব্যবস্থা করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।’
ইনশার স্বামী ইরফান আহমেদ শেখ এখনো তার প্রথম সন্তানের জন্মের খবর জানেন না। তিনিও একজন অটোরিকশা চালক। কিন্তু টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ব্রডব্যান্ডসহ সবধরনের যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ থাকায় এবং সাধারণ মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় ইরফান আহমেদ শেখ তার সন্তানের জন্মের খবর জানতে পারেননি।
ওদিক লাল দেদ হাসপাতালের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেখানে অসংখ্য মা সন্তান প্রসব করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েও বাড়ি ফিরতে পারছেন না। কারফিউর কারণে তারা বাইরে বের হতে পারছেন না। ফলে হাসপাতালেই পড়ে আছেন তারা। যেখানে না আছে ভালো ঘুমানোর জায়গা না আছে খাওয়ার জায়গা।
এমনই একজন ৩৮ বছর বয়সী রাশিদ আলি গত ২ আগস্ট থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে ওই হাসপাতালে পড়ে আছেন। ৫ আগস্ট তাদের হাসপাতাল ছাড়ার কথা ছিলো। উত্তর কাশ্মীরের বারামুল্লা জেলার উরি শহর থেকে এসেছেন তারা। তারা সহ আরো অনেককে হাসপাতালের সবার উপরতলার একটি বড় হল রুমে রাখা হয়েছে।
এছাড়া হাসপাতালের সামনের চত্বরে এবং বারান্দায়ও আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। তাদের অনেকেরই সঙ্গে কোনো টাকা-পয়সা নেই। ফলে খাবারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে অন্যদের কাছে। দিনমুজুর রাশিদ আলি বলেন, ‘গত ৮ আগস্টেই আমার টাকা ফুরিয়ে গেছে। ফলে এখন আমি অন্যদের কাছে হাত পাততে বাধ্য হচ্ছি খাবার কেনার টাকার জন্য।’
ডা. সামরিনা নামে হাসপাতালটির একজন আবাসিক ডাক্তার জানান, ‘অনেক ডাক্তার এবং কর্মীরা এখন রাত-দিন কাজ করছেন। তাদেরকে বাড়ি যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কেননা কারফিউর কারণে দূরে থাকা ডাক্তার এবং কর্মীরা হাসপাতাল ছেড়ে যেতে পারছেন না আবার আসতেও পারছেন না। কাছাকাছি থাকেন যারা তাদেরকে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। আর বাকীদের হাসপাতালের কয়েকটি রুমে গাদাগাদি করে থাকতে দেওয়া হয়েছে।’ সূত্র: দ্য ওয়্যার