শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ০১:১৮:১৭

মুসলিমরা স্বভাবগত ভাবেই অপ'রাধ প্রবণ : বলছে ভারতের সমীক্ষা রিপোর্ট

মুসলিমরা স্বভাবগত ভাবেই অপ'রাধ প্রবণ : বলছে ভারতের সমীক্ষা রিপোর্ট

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আইনের চোখে 'সবাই সমান।' কিন্তু আইনরক্ষকদের মনেই যদি বিভিন্ন জাতি-ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব থাকে, আস্থা-অনাস্থায় প্রভেদ থাকে— তবে সেই আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিয়ে গভীর সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়। 

যেমন তৈরি হয়েছে ভারতের পুলিশকর্মীদের নিয়ে সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর। সমীক্ষা বলছে— এ দেশের অন্তত অর্ধেক পুলিশকর্মী বিশ্বাস করেন, মুসলিমরা স্বভাবগত ভাবেই অ'পরা'ধপ্রবণ।

'স্টেটাস অব পোলিসিং ইন ইন্ডিয়া ২০১৯' শীর্ষক সমীক্ষার রিপোর্টটি তৈরি করেছে মানবাধিকার সংগঠন 'কমনকজ' এবং ভারতের নামী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিস’ (সিএসডিএস)-এর 'লোকনীতি প্রোগ্রাম'। 

সমীক্ষার বিষয়বস্তু ছিল পদমর্যাদা এবং লিঙ্গ অনুযায়ী পুলিশের পরিকাঠামো, ভারতীয় পুলিশকর্মী-অফিসারদের কাজের পরিবেশ, কাজের সময়, অপ'রাধের তদন্তে প্রভাবের মতো নানা বিষয়। শুধু পুলিশকর্মীদের পেশাগত কাজের সুবিধা-অসুবিধা বা পরিবেশ-পরিস্থিতি জানাই নয়, সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে পুলিশকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গিও এই সমীক্ষার অন্তর্গত।

রিপোর্ট তৈরি করতে সারা দেশের ১২ হাজার পুলিশকর্মী-অফিসারের মতামত নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের উপর প্রশ্নের উত্তর জানার পর তৈরি হয়েছে ১৮৮ পাতার রিপোর্ট। এ ছাড়া পুলিশকর্মীদের উপর কতটা কাজের চাপ থাকে, পরিবারকে কতটা সময় দিতে পারেন— এই সব বিষয়ে জানার জন্য পুলিশকর্মীদের পরিবারের মোট ১১ হাজার সদস্যের মতামতও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সমীক্ষা রিপোর্টে।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ মনে করেন মুসলিমরা খুব বেশি অ'পরা'ধপ্রবণ। ৩৬ শতাংশ মনে করেন মোটামুটি অ'পরা'ধপ্রবণ। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ মতদাতাই বলছেন মুসলিমরা অ'পরা'ধপ্রবণ। যদিও বাকি ৫০ শতাংশের মধ্যে ২৫ শতাংশ বলছেন— মুসলিমদের এমন ভাবে অপ'রাধপ্রবণ ভাবার তারা পক্ষপাতী নন, ১৭ শতাংশ বলছেন মুসলিমদের কোনও ভাবেই অপ'রাধপ্র'বণ ভাবেন না তারা। বাকি ৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এ নিয়ে কোনও মতামত দিতে চাননি।

এই মনোভাব অন্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে কী রকম? উচ্চবর্ণ হিন্দুদের সম্পর্কে উত্তরদাতাদের ৬ শতাংশের মনোভাব— এরা খুবই অপ'রাধ'প্রবণ, ২৬ শতাংশ মনে করেন— মোটামুটি অপরাধপ্রবণ। ৩২ শতাংশের মত তেমন অপ'রাধ'প্রবণ নন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা এবং ২৪ শতাংশ মনে করেন তারা একদমই অপ'রাধ'প্রবণ নন। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, দলিত, আদিবাসী বা জনজাতিদের অপ'রাধপ্র'বণতা নিয়েও পুলিশকর্মীদের মতামত প্রায় একই রকম।

সমীক্ষা রিপোর্টে ‘পুলিশ ও সমাজ’ বলে আলাদা একটা পরিচ্ছেদ রয়েছে। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যেকার অপ'রাধ'প্রব'ণতা নিয়ে পুলিশকর্মীদের মতামত নেওয়ার উপরেই তৈরি হয়েছে রিপোর্টের এই অংশটি। কারা কেমন অপরাধপ্রবণ বলে পুলিশ কর্মীরা মনে করেন, সেটাই ছিল প্রশ্ন। 

এই অংশে সমীক্ষায় মতামত দেওয়া পুলিশ কর্মী-অফিসারদের ৫০ শতাংশই বিশ্বাস করেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ‘স্বাভাবিক ভাবেই অপ'রাধ প্রবণ’। একই প্রশ্ন উল্টো দিক থেকেও করা হয়েছিল, যে মুসলিমরা কি কম অপ'রাধ প্রবণ? তাতেও কার্যত একই ফলাফল এসেছে।

সমীক্ষার ফলাফলকে যদি সত্যের কাছাকাছি ধরে নেওয়া যায়, তা হলে এর পিছনে সমাজব্যবস্থা এবং রাজনীতিও দায়ী— মনে করেন মনঃসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ। তার বক্তব্য, ‘আমরা যে পরিবেশে বড় হই, তাতে অন্য ধর্মের মানুষকে অপ'রা'ধী বা অ'পরা'ধপ্র'বণ হিসেবে দেখানোর একটা চেষ্টা থাকে। সচেতন ভাবে না হলেও স্বাভাবিক ভাবে বা অনেকটা অজান্তেই আমাদের মধ্যে এই মনোভাব ঢুকে পড়ে। এমন মনোভাব তৈরি হয় যে, আমি যা খাই সেটা ঠিক, অন্যদেরটা ভুল। আমরা ঠিক, অন্য ধর্মের মানুষ ভুল।” 

মোহিতের মতে, কোনও একটি সম্প্রদায় নয়, বরং সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই কমবেশি এই মনস্তাত্ত্বিক গঠন তৈরি হয়ে যায়। তার কথায়, 'পুলিশে যারা চাকরি করছেন, তারাও সমাজেরই অংশ। ফলে তাদের মধ্যেও এই ধারণা অজান্তেই থেকে যায়। সমীক্ষায় সেটাই উঠে এসেছে।'

রাজ্যের বিজেপির মুখপাত্র এবং তাত্ত্বিক নেতা শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য সমীক্ষার ফলাফল নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই সমীক্ষা থেকে পুলিশের মনস্তত্ত্ব ফুটে উঠেছে বলে আমি মনে করি না। হয়তো অপরাধের নানা পরিসংখানের ভিত্তিতেই পুলিশকর্মীরা সমীক্ষকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান সব সময় সামগ্রিক ছবিটা তুলে ধরে না।’

শমীকের কথায়, ‘আমি বা আমার দল সব সময়ই সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে। এরা অপরাধপ্রণ, ওরা নন— আমরা এ ভাবে ভাবি না। আমার মনে হয় এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র, অশিক্ষা এবং কিছু লোকের খাড়া করা কিছু ভুল তত্ত্বের কারণে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে মুসলিমরা বেশি অপরাধপ্রবণ।’

তৃণমূল নেতা তথা ইতিহাসবিদ নির্বেদ রায়ের মতে, সমীক্ষার ফলাফলের পিছনে ‘কারণটা প্রায় পুরোটাই সামাজিক। শিক্ষা থেকে শুরু করে মুসলিমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। ফলে তাদের অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেশি থাকে।’ তবে সমীক্ষার নমুনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বেশি থাকাতেও যে ফলাফলের উপর প্রভাব ফেলেছে, তাও মনে করেন নির্বেদবাবু।

মোহিত রণদীপ অবশ্য সমাজ বা পুলিশের সংখ্যাগুরু অংশে এমন মনোভাবের পিছনে রাজনীতির হাতও দেখছেন। তার মতে, ‘যখন থেকে ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ার হয়েছে, তখন থেকে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। দেশে হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রবল হাওয়া চলছে। মূল সমাজ থেকে আমরা দূরে সরিয়ে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছি। এই মনোভাবও প্রভাব ফেলেছে সমীক্ষায়।’ সূত্র : আনন্দবাজার

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে