শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৮:১৩:৫৫

জার্মানির অনন্য গল্প

জার্মানির অনন্য গল্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : শরণার্থীদের চোখে এক অনন্য জার্মানি ধরা পড়েছে। তাদের মুখে এখন যে গল্প উচ্চারিত হচ্ছে তা শুনলে পুলকিত হবেন আপনিও। গল্পর মূলে রয়েছে 'গুড জার্মানি। এক দল শিশু হাসছে-খেলছে, স্থানটি যে শরণার্থী শিবির তা বোঝার জো নেই তাদের দেখে; কঠিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যে তাদের আসা, উচ্ছ্বাস ঢেকে দিয়েছে তা-ও। বার্লিন শহরে একটি শরণার্থী শিবির এটি ‘মেসে বার্লিন’। এক ছাদের নিচে বিশাল এই খোলা জায়গাটি ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের মেলা-উৎসবের জন্য, এখন তাতে ঠাঁই করে দেওয়া হয়েছে শরণার্থীদের। এখানে শরণার্থীদের দেখভাল করছে দাতব্য সংস্থা মালটিজার। ১ হাজার শরণার্থী রয়েছে এখানে, তার মধ্যে ২০০টি শিশু। সার বাধা তাঁবু, প্রতিটি তাঁবুর সামনে ছবি আঁকা। এই ছবি কেন- জানতে চাইলে এই শরণার্থী শিবিরের সমন্বয়ক এশিয়া আফনেহ-সুরেকি বলেন, “ছোট ছোট বাচ্চাগুলো তো পড়তে পারে না, তাই তারা যেন নিজের তাঁবু না হারিয়ে ফেলে সেজন্য এই পদক্ষেপ। ছবি দেখে নিজের তাঁবু চিনে নিতে পারে তারা।” শরণার্থীদের বিষয়ে জার্মানি কতটা মনোযোগী, তা ফুটে ওঠে ছোট্ট এই ঘটনায়ই। বার্লিনেরই আরেকটি স্থান টেম্পলহোপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের তিনটি হ্যাঙ্গার এখন শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল। এখানে ঠাঁই মিলেছে ২ হাজারের বেশি শরণার্থীর । এটি চালাচ্ছে তামাইয়া সোসাল সার্ভিস। বেসরকারি এই সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা মারিয়া কিপ জানান, তিনটি হ্যাঙ্গারে থাকা তাঁবুতে দুই হাজারের বেশি শরণার্থী রয়েছে এখন। বার্লিন থেকে দেড়শ মাইল দূরে শেরিন শহর, মেকলেনবার্গ-ভোরপোমের্ন রাজ্যের রাজধানী এটি। শহরটিতে আশ্রয় পেয়েছে ৩ হাজার শরণার্থী। কারিতাসের উদ্যোগে সেখানে একটি ক্যাফেতে দেখা গেল আড্ডায় মগ্ন শরণার্থীদের, বিভিন্ন দেশের, সেই আড্ডায় জার্মানরাও রয়েছে। মিথষ্ক্রিয়া সৃষ্টির জন্য এই পদক্ষেপে সহায়তা করছে নগর কর্তৃপক্ষও। শরণার্থী হিসেবে সেখানে আশ্রয় পাওয়া আফগানিস্তানের আহমেদ নামে এক তরুণ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, ‘জার্মানি (ইজ) গুড।’ এশিয়ার নয়টি দেশের নয়টি সংবাদ মাধ্যমের নয়জন সাংবাদিককে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমন্ত্রণ জানায় শরণার্থী পরিস্থিতি ঘুরে দেখতে। এর মধ্যে ছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে ৮ কোটির বেশি জনসংখ্যার সঙ্গে এই বছরই যোগ হয়েছে ১০ লাখ শরণার্থী, যাদের বেশিরভাগই এসেছে সিরিয়া থেকে। শুধু সিরিয়ারই নয়, এশিয়ার আফগানিস্তান, ইরাক, আফ্রিকার ইরিত্রিয়া, ইউরোপের বলকান রাষ্ট্রগুলোসহ নানা দেশ থেকে মানুষ এসে ঠাঁই নিয়েছে জার্মানিতে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি আইএসের সঙ্গে ত্রিমুখী যুদ্ধ শুরুর পর জার্মানিতে ঢল নামে বাস্তুহারাদের। ইউরোপের অনেক দেশের যখন নিতে আপত্তি, তখন গত সেপ্টেম্বরে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল সিদ্ধান্ত নেন সীমান্ত খুলে দেওয়ার। বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরিতে যখন শরণার্থীরা অনেকটাই নিগৃহীত, তখন যুদ্ধপীড়িত মানুষগুলোকে ‘ভিলকোমেন (ওয়েলকাম)’ জানিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে সরকার প্রধান মের্কেলের সমর্থনে দাঁড়াতে দেখা যায় জার্মান নাগরিকদের। শরণার্থীদের এভাবে গ্রহণকে জার্মান সংস্কৃতির অংশ বলেই দাবি করছেন হামবুর্গের কিয়েল ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেসের ডেপুটি প্রফেসর ড. ভাসিলিস সানিয়োসের। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় প্রচুর অভিবাসীকে জার্মানি গ্রহণ করেছিল। এরপর রাশিয়ার পতনের পর বলকান রাষ্ট্রগুলো থেকেও বহু মানুষ জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছে। এই শতকে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিই সবচেয়ে বেশ অভিবাসী নিয়েছে। অভিবাসীরা কেন জার্মানিকে বেছে নিচ্ছে এমন প্রশ্নে ড. সানিয়োসের উত্তর, “ভিনদেশিদের সমাজে সম্পৃক্ত করে নিতে জার্মানির নীতি প্রগতিশীল বলে।” ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শরণার্থী আসছে জার্মানিতে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের এই মুসলিম শরণার্থীদের নিয়ে কোনো শঙ্কা কাজ করছে কি না, জানতে চাইলে নেতিবাচক উত্তর আসে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাছ থেকে। তিনি উল্টো বোঝান, আসলে প্যারিস হামলাকারীদের একজন সিরিয়া থেকে শরণার্থীদের ভিড়ের মধ্যে এসেছিল বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা প্রমাণিত নয়। ঘটনাস্থলে একটি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে, কিন্তু এক ব্যক্তির নামে বহু মানুষের ভুয়া পাসপোর্ট বহু থাকার নজির মিলেছে সিরিয়ায়। ফলে এটা বলা যাচ্ছে না যে হামলাকারীদের একজন শরণার্থী। শুধু যে বাস্তচ্যুত মানুষই আসছে জার্মানিতে তা নয়। কাজের সন্ধানে, ভাগ্য বদলের আশায় অনেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে দেশটিতে। আর দুটিকে আলাদাভাবে না দেখে সবাইকে অভিবাসী হিসেবে নেওয়ার প্রস্তুতিই জার্মানির। তাই অধ্যাপক সিয়ানোসের কথার প্রতিধ্বনি তোলেন শেরিনের ডেপুটি মেয়র অ্যান্ড্রেয়াস রুহলও- “এই শরণার্থীরা আমাদের সম্পদ, তারা আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।” ১৮ বছরের তরুণ আতাউল্লাহ, মেসে বার্লিনে কাজ করছেন মালটিজারের (সভেরেইন অর্ডার অফ মাল্টা) সংগঠকদের সঙ্গে। এই শরণার্থী শিবিরের ১ হাজার শরণার্থীর ৩০ ভাগ আফগান এবং ৩০ ভাগ সিরীয় বলে জানালেন শরণার্থী শিবিরের সমন্বয়ক এশিয়া আফনেহ-সুরেকি। জার্মানিতে পাড়ি জমালেও ভাষা একটি বড় সমস্যা শরণার্থী এবং দাতব্য সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী উভয়ের জন্যই। তাই শরণার্থীদের মধ্য থেকে যারা ইংরেজি জানেন তাদের বেছে নেওয়া হয়েছে দোভাষি হিসেবে কাজ করার জন্য। পশতুভাষী তরুণ আতাউল্লাহ করছেন এই কাজটিই। আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর কুন্দুজ থেকে দুর্গম পথ পেরিয়ে এখন জার্মানিতে তিনি। কীভাবে এলেন- জানতে চাইলে আতাউল্লাহ বলেন, আফগানিস্তান থেকে ইরান, ইরাক, জর্ডান, তুরস্কের পর বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানি পৌঁছেছেন তিনি। দীর্ঘ এই পথ পেরুতে গিয়ে কখনও হেঁটে, কখনও বাসে, কখনও নৌকায় চড়তে হয়েছে আতাউল্লাহকে। তবে নিখরচায় নয়, দালালকে ৮ হাজার ডলার দিয়ে তবেই জার্মানিতে পৌঁছার এই পথ করেছেন বলে জানান এই তরুণ। বন্ধুদের কাছে ধার-দেনা করে এই অর্থ সংগ্রহ করেছেন এই তরুণ। বাবা-মা-ভাইকে ছেড়ে কেন এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ভিনদেশে- জানতে চাইলে উত্তর আসে, “আমি তালেবানকে ঘৃণা করি। তারা ভালো মানুষ নয়।” শরণার্থী শিবিরে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না বলে জানালেন তিনি। থাকার জন্য একটি স্থান পেয়েছেন, শীতে গরম কাপড়ও পাচ্ছেন, চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকও আছে। “আমরা খুব খুশি, এখানে নিয়ম-নীতি বেশ ভালো, জার্মানদের আচরণ খুব ভালো,” বলেন এই আফগান তরুণ। আতাউল্লাহর মতো অনেককে পাওয়া গেল, যারা ঠিক বাস্তহারা নয়; দেশে অনিশ্চয়তা তাদের নিয়ে এসেছে জার্মানিতে। এদের অনেকের হাতেই রয়েছে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেটে ব্রাউজও করছিলেন তারা। তবে তাদের মতো নয় ইরাকের বাগদাদ থেকে আসা মুস্তফা। স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। ১২ বছরের বড় ছেলেটি পঙ্গু, ছয় বছরের মেজ ছেলেটিরও হাত ক্ষতিগ্রস্ত। এই ইরাকি জানালেন, পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে তার দুই সন্তানের এই অবস্থা। স্বদেশে বিপদ থেকে বাঁচতে বিদেশে এখন শরণার্থী হয়ে আছেন মুস্তফারা। সিরীয় কয়েকজন তরুণও নিজের ভাষায় বোঝালেন, তার দেশে তার জীবন কতটা বিপন্ন। আতাউল্লাহর মতো কয়েকজন তরুণ বললেন, তারা লেখাপড়া করতে চান। কেউ কেউ সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছাও জানালেন। কিন্তু স্বদেশে যে প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের পড়াশোনা এগিয়েছে, তা জার্মানিতে অব্যাহত রাখা যে কঠিন, তা স্বেচ্ছাসেবীদের কথায় স্পষ্ট হল। সেক্ষেত্রে এই তরুণদের সামনে খোলা আছে বৃত্তিমূলক শিক্ষার পথ। শরণার্থী হিসেবে নাম নিবন্ধনের পর প্রত্যেকে ১০০ ইউরোর মতো পান মাসে। তবে সেই অর্থ তুলতে গিয়ে বিড়ম্বনার কথাও বললেন কেউ কেউ। আফগানদের অভিযোগ, সিরীয় শরণার্থীদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। সে কারণে তাদের পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব মাইগ্রেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে বলে তারা এখন সিরীয় শরণার্থীদের গুরুত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে আফগানিস্তানে নিরাপত্তায় জার্মান সৈন্যরাও কাজ করছে। সে দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দেশটি থেকে শরণার্থী কমিয়ে আনতে চাইছে জার্মান সরকার। দালালদের প্রলোভনে পড়ে কেউ যেন জার্মানি যেতে উৎসাহিত না হয়, সেজন্য প্রচার-প্রচারণাও চালানো হচ্ছে আফগানিস্তানে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বলছেন তার দেশের নাগরিকদের ফিরে আসতে, দেশ পুনর্গঠনে কাজে লাগতে। কিন্তু শরণার্থী শিবিরের এই তরুণরা ফিরতে নারাজ, তাদের ভয় ‘ব্যাড পিপল’ তালেবানকে। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে