হাসপাতালে ফেলে যাওয়া ছেলের জন্যই কাঁদছেন মা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে উধাও ছেলে৷ তবুও সেই ছেলের জন্যই হাসপাতালে শুয়ে কাঁদছেন অসহায় মা৷ পালানোর আগে মাকে দিয়ে ৩ লাখ টাকার চেকে সই করিয়ে নিয়েছে ছেলে৷ এর কিছু টাকা হাসপাতালে দিয়েছে৷ বাকিটা নিয়ে একেবারে উধাও৷
মা অপেক্ষায়, ছেলে নিশ্চয় কাজে আটকে পড়েছে৷ আসবে হয়তো কয়েকদিন পরেই৷ তারপর ছেলের হাত ধরে বাড়ি ফিরবেন৷ বাড়ির ঠিকানাও ভুল দিয়েছিল ছেলে৷ এতে নাজেহাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷ ছেলের ফোনও বন্ধ৷
পুলিশও হাত গুটিয়ে নিয়েছে৷ তবু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ওই মা বলছেন, দেখবেন, ছেলে আসবে ঠিকই৷ হয়তো জরুরি কাজে আটকে পড়েছে৷ মায়ের নাম উমা চাবরি৷ বয়স ৬২৷ স্বামী জয়দেব চাবরি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন৷
কর্মরত অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি৷ একমাত্র ছেলে অরূপের সঙ্গে থাকতেন রাজারহাটের একটি বেসরকারি টাউনশিপে৷ গত ২১ নভেম্বর সকালে মা হৃদরোগে আক্রান্ত হন৷ ছেলে অরূপ বাড়িতে ডাক্তার ডেকে আনেন৷
তড়িঘড়ি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের নথিভুক্ত তেঘড়িয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করেন অরূপ৷ একদিন পরই উমাদেবীর বুকে পেসমেকার বসানো হয়৷ নথিভুক্ত হাসপাতাল থাকায় বিল নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না৷
যদিও অরূপ মাকে দিয়ে তিন লক্ষ টাকার একটি চেক সই করিয়ে নেয়৷ তার পর সে হাসপাতালে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা জমা দেয়৷ এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল৷ প্রথম এক সন্তাহ মায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিয়মিত হাসপাতালে আসত অরূপ৷
কিন্ত্ত উমাদেবীকে জেনারেল ওয়ার্ডে দেয়ার পরদিন থেকেই কার্যত লাপাত্তা অরূপ৷ হাসপাতালের কর্তা থেকে ডাক্তার-কেউই ছেলেকে সামনে পাচ্ছিলেন না৷ ফোন করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না৷
উমাদেবীর ছেলের জন্য ছটফট করতে থাকেন৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, হন্তা দুই আগে এক রাতে আচমকা হাজির হয় অরূপ৷ রীতিমতো জোর করে বেসামাল অবস্থায় মহিলাদের ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন৷
মাকে প্রতিশ্রীতি দেন, খুব শিগগিরই বাড়িতে নিয়ে যাবেন৷ কিন্ত্ত ফের গায়েব কীর্তিমান ছেলে৷ গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলো অরূপের বাড়ির ঠিকানা৷ ভর্তির সময় দেয়া ঠিকানায় গিয়ে হাসপাতাল কর্মীরা জানতে পারেন, সেটা ভুল৷ এরপর উমাদেবী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সঠিক ঠিকানা জানান৷ কিন্ত্ত তাতেও খুব একটা সুরাহা হয়নি৷
সমস্যা বেড়েছে পুলিশি অসহযোগিতায়৷ স্থানীয় বাগুইআটি থানায় আটদিন আগে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ কিন্ত্ত পুলিশ উমাদেবীকে হোমে পাঠানোর পরামর্শ দেয়৷ হাসপাতালের মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট উত্পল চট্টোপাধ্যায় বলেন, এখন আমাদের বিড়ম্বনা আরো বেড়েছে৷ আমরা উদ্বিগ্ন৷ উমাদেবী এখন সুস্থ৷ কিন্ত্ত সারাদিন ছটফট করছেন৷ যখন-তখন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে৷
মঙ্গলবার দুপুরে বেডে বসে চোখের জল মুছতে মুছতে উমাদেবী বলেন, ছেলেকে নিয়ে বরাবরই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে৷ জয়পুরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরও কোনো স্থায়ী চাকরি করেনি ছেলে৷ ব্যবসা করতে গিয়ে একাধিকবার লাখ লাখ টাকা বেহাতও হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন উমাদেবী৷
কিন্ত্ত পুত্রস্নেহে ছেলের ব্যবসার উদ্যোগে বাধা দিতে পারেননি৷ ভাড়া টাকা ক্রমশ শূন্য হয়ে আসায় কম টাকায় ভাড়া থাকতেন রাজারহাট নিউটাউনে একটি বেসরকারি টাউনশিপে৷ সেখানেই গত নভেম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷
উমাদেবী ডাক্তারদের কাছে কাতর আবেদন করছেন, আমাকে গাড়ি করে নিয়ে চলুন৷ আমি বাড়ি চিনিয়ে দেব৷ ছেলে কোনো কাজে আটকে পড়েছে বলে হয়তো আসতে পারছে না৷ ছেলের কথা বলতে গিয়ে স্বীকার করেই ফেললেন, আত্মীয়দের খবর দেননি৷ তারা যদি ছেলের নিন্দা করেন৷
মঙ্গলবার বিকেলে কৈখালির ঠিকানায় এবং রাজারহাটের সেই বেসরকারি টাউনশিপে গিয়েও হতভাগ্য প্রৌঢ়ার ছেলে অরূপের খোঁজ মেলেনি৷ অরূপেরফোন নম্বরে লাগাতার যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি৷ ফোন সুইচড অফ ছিল৷ মেসেজেরও কোনো উত্তর মেলেনি৷
উমাদেবীর মেয়ে সবিতা মারা গেছেন। জামাইও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে কর্মরত৷ আদতে মেদিনীপুরের বাসিন্দা হলেও উমাদেবী থাকতেন এয়ারপোর্টের কাছে কৈখালির চিড়িয়ামোড়ে নিজস্ব বাড়িতে৷
স্বামী মারা যাওয়ার পর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য মিলেছিল যথেষ্ট৷ এরই মধ্যে তিন বছর আগে কৈখালির বাড়িতে থাকতে শুরু করেন মেয়ে৷ সঙ্গে থাকতে শুরু করেন জামাই ও নাতনিও৷
উমাদেবী জানান, এরই মধ্যে মেয়ে সবিতা অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ পেটে অস্ত্রোপচারের সময় তার মৃত্যু হয়৷ এর কিছুদিন পরই কৈখালির বাড়ি বিক্রি করে দেয়া হয়৷ জামাই ও নাতনিকে নিয়ে অন্যত্র থাকতে শুরু করে উমাদেবী৷ সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া
৩০ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম