বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ০৯:৫৭:৩৫

ইসরায়েল নিয়ে সৌদি রাজপরিবারে তুমুল মতবিরো'ধ

ইসরায়েল নিয়ে সৌদি রাজপরিবারে তুমুল মতবিরো'ধ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : উপসাগরে নিজেদের অনুগত দুই দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চু'ক্তি করে ফেললেও সৌদি শা'সকদের মধ্যে দ্বি'ধা এবং ম'তভে'দের খবর প্রাসাদের দেয়াল পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। এ নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবে'দন প্রকা'শ করেছে বিবিসি।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সৌদি রাজপরিবার এবং সরকারের প্রভা'বশালী কিছু ব্যক্তির সাম্প্রতিক বক্তব্য, বিবৃতি এবং ক্ষ'মতাধর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মৌনতা দেখে মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্লে'ষকরা বলতে শুরু করেছেন যে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সৌদি আরব এখনও দ্বি'ধা-দ্ব'ন্দ্বের মধ্যে রয়েছে। তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই চা'পাচা'পি করুন আর যুবরাজ মোহাম্মদ যতই উৎ'সা'হী হোন না কেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন এখনই হচ্ছে না।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বিশেষজ্ঞ নায়েল শামা বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে সৌদি রাজপরিবারের ভেতর এখনও যে অনেক দ্বি'ধা-দ্ব'ন্দ্ব রয়েছে, তা নিয়ে কোনো স'ন্দে'হ নেই। তার মতে, ''ক্ষ'মতাধ'র যুবরাজ বিন সালমান দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন, কিন্তু তার বাবা বাদশাহ সালমান এখনও দ্বি'ধায় রয়েছেন।''

সৌদি রাজপরিবারে বিভে'দ : প্রভা'বশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত সপ্তাহে তাদের একটি অনুস'ন্ধা'নী প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্নে সৌদি রাজপরিবারে বিভে'দ দেখা দিয়েছে। পত্রিকাটির দাবি, চু'ক্তির আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলি এবং আমেরিকান কর্মকর্তাদের মধ্যে গো'পন দেন-দরবার, দর ক'ষাক'ষির ব্যাপারে সমস্ত কিছু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ জানলেও বাবার কাছে তিনি তা গো'পন রাখেন।

মার্কিন আরেক প্রভা'বশালী সাময়িকী টাইমের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, বাদশাহ সালমান ক্ষি'প্ত হতে পারেন এই ভয়ে বাহরাইন চু'ক্তি করতে ই'তস্ত'ত করছিল, কিন্তু যুবরাজ মোহাম্মদ তাদের আ'শ্ব'স্ত করেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানাচ্ছে, বাদশাহ সালমান এ নিয়ে ছেলের প্রতি ক্ষু'ব্ধ হয়েছেন এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও জেরুজালেম নিয়ে সৌদি প্র'তিশ্রু'তি নতুন করে তু'লে ধ'রার জন্য তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি নির্দে'শ দিয়ে দেন। তাই আগস্টে আমিরাত সিদ্ধান্ত জানানোর পরপরই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সল বিন ফারহান জার্মানিতে এক সফর করেন।

সেখানে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ''ফিলিস্তিন স'ঙ্ক'ট সমাধানের ইস্যু অ'গ্রা'হ্য করার প্রশ্নই আসে না।'' গত সপ্তাহে সৌদি রাজপরিবারের প্রভা'বশালী সদস্য, সাবেক গো'য়ে'ন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল সৌদি দৈনিক আশরাক আল আওসাতে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, ''সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছে এমন যে কোনো আরব দেশের উচিত 'ইসরায়েলের কাছে উঁচু মূল্য দাবি করা।' প্রিন্স তুর্কি আরও লিখেছেন, ''সৌদি আরব একটি দাম ধার্য করেছে। আর তা হলো, 'স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে— যার রাজধানী হবে জেরুজালেম।''

সেই দ্বি'ধার প্রথম ল'ক্ষ'ণ দেখা গেছে গত ২৩ সেপ্টেম্বর যখন বাদশাহ সালমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তার ভাষণে পরি'ষ্কার বলেন যে, সৌদি আরব এখনও ২০০২ সালের আরব শান্তি পরিক'ল্পনার প্রতি প্রতি'শ্রু'তিব'দ্ধ। তিনি বলেন, ''ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তখনই সম্ভব, যখন তারা পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজি হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা নিজের ছেলের ইচ্ছার তো'য়া'ক্কা যে সৌদি বাদশাহ করছেন না, তার আরও নমুনা চোখে পড়ছে।''

পর্দার আড়ালের সম্পর্ক : মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভা'ব কমতে থাকা এবং সেই সঙ্গে শিয়া সং'খ্যাগ'রি'ষ্ঠ ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক উ'চ্চাভি'লাষ নিয়ে সৌদি আরব আ'ত'ঙ্কি'ত। সৌদি বাদশাহ এখন মুখে যত কথাই বলুন না কেন, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধ'রে পর্দার আড়ালে তার সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। কিন্তু সেই সম্পর্ককে প্রকা'শ্যে নিয়ে আসার প্রথম ই'ঙ্গিত পাওয়া যায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে যুবরাজ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়।

সৌদি যুবরাজ সেখানে মার্কিন ইহুদি নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে খো'লাখু'লি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের ক'ড়া স'মালো'চনা করে বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের নমনীয় হতে হবে। ওই বৈঠক নিয়ে সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যম লেখা হয়, সৌদি যুবরাজ খো'লাখু'লি বলেন যে, ফিলিস্তিন স'ঙ্ক'টের সমাধান সৌদি আরব চায়, কিন্তু 'ইরানের মো'কাবিলা এখন তাদের কাছে আরও অনেক গু'রু'ত্বপূর্ণ অগ্রা'ধিকার।'

পর্যবে'ক্ষকরা মনে করছেন, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং উপসাগরীয় আরব শাসকদের অনেকেই এখন মনে করছেন, ফিলিস্তিন সম'স্যা নিয়ে বসে থাকা সময়ের অ'পচ'য় এবং জাতীয় স্বা'র্থবি'রো'ধী। ইরানকে ঠে'কানো এবং প্রযু'ক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ককে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তেলের ওপর নির্ভরতা ক'মাতে যুবরাজ বিন সালমান 'ভিশন-২০৩০' নামে যে পরিক'ল্পনা নিয়েছেন, ইসরায়েলকে তার অংশীদার করতে তিনি আগ্রহী।

সৌদি বাদশাহর দ্বি'ধা কেন : কিন্তু তারপরও সৌদি রাজপরিবার ও শা'সকদের একাংশের মধ্যে এমন দ্বি'ধা কেন? ড. নায়েল শামা বলছেন, দৃ'ষ্টিভ'ঙ্গির 'প্রজন্মগত' পার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমনই এর পাশাপাশি ইসলামি দুনিয়ায় নেতৃত্ব ধ'রে রাখা নিয়ে সৌদি রাজপরিবার ও সৌদি রাষ্ট্রের প্রভা'বশা'লী বি'রাট একটি অংশের মধ্যে উ'দ্বে'গ রয়েছে।

এই অংশটি মনে করে, ফিলিস্তিনি স্বা'ধিকার, জেরুজালেম এবং আল-আকসা মসজিদের ওপর আরবদের নিয়'ন্ত্রণের ইস্যুতে আ'পো'ষ করলে ম'ক্কা ও মদিনার মসজিদের র'ক্ষ'ক হিসাবে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে সৌদি রাজপরিবার বা সৌদি আরবের গ্র'হণযো'গ্যতা হু'মকিতে পড়বে। তিনি বলেন, 'ইসলামি নেতৃত্বের ঝা'ণ্ডা ধ'রে রাখাকে সৌদি রাজপরিবার গু'রুত্ব দেয়। তারা মনে করে এই প্রভা'ব তাদের সবচেয়ে বড় কূ'টনৈ'তিক অ'স্ত্র। সংযুক্ত আরব আমিরাত বা বাহরাইনের এমন কোনো আ'কা'ঙ্ক্ষা নেই।'' 

এ ছাড়াও তিনি বলেন, ''আমিরাতের বর্তমান শা'সকরা যেমন তাদের সমাজ ও রাজনীতি থেকে ইসলামি প্রভা'ব ঝে'ড়ে ফেলতে উন্মুখ, 'সৌদি রাজপরিবার এখনও তেমনটা একেবারেই ভাবে না।' সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইসলামি বিশ্বে নেতৃত্ব নেয়ার জন্য তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের নতুন আকা'ঙ্ক্ষা।

সৌদি জনমত : পাশাপাশি অনেক প'র্যবে'ক্ষক মনে করেন, বিনিময়ে কোনো কিছু আদায় না করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া সাধারণ সৌদিদের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য হবে না— এ নিয়েও সৌদি রাজপরিবারের একাংশের মধ্যে উ'দ্বে'গ রয়েছে। সৌদি জনমতের কিছুটা আঁ'চ পাওয়া গেছে আমিরাত-বাইরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের চু'ক্তির দিন। ওয়াশিংটনে ১৫ সেপ্টেম্বর চু'ক্তির পরপরই 'এই স্বাভাবিক সম্পর্ক বিশ্বা'সঘা'তকতা' এমন টুইটার হ্যা'শট্যা'গ সৌদি ঝড় ওঠে।

একই সঙ্গে টুইটারে বহু পুরনো একটি ভিডিও ফুটেজ পোস্ট করার পর অসংখ্য সৌদি তাতে লাইক দিয়েছেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রয়াত সৌদি বাদশাহ ফয়সল ক্রু'দ্ধ স্বরে বলছেন, ''সমস্ত আরব বিশ্বও যদি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়, ফিলিস্তিনের বিভক্তি মেনে নেয়, সৌদি আরব তার সঙ্গে কখনোই গলা মেলাবে না।'' ওই ভিডিও ফুটেজে বাদশাহ ফয়সলের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বর্তমান বাদশাহ সালমান।

অনেকের ধা'রণা ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো ছাড় না পেয়েও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকে ৮৪ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান হয়ত ব্যক্তিগতভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তবে জনমতের বিবেচনা খুব বেশি কাজ করছে বলে মনে করছেন না ড. নায়েল শামা। তিনি বলেন, ''এটা ঠিক যে সৌদি জনগণের সিংহভাগই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আদৌ উৎসাহী নন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের বিরো'ধিতা করার সংস্কৃতি দেশটিতে নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন যে হবে, সে সম্ভাবনাও অদূর ভবিষ্যতে নেই।''

সৌদি বাদশাহ কি ফাঁকা দাবি করছেন? : কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে সৌদি বাদশাহ গোঁ ধ'রে রয়েছেন, তা কতটা যৌ'ক্তিক? ইসরায়েল কি এখন তাতে আদৌ কান দেবে, বিশেষ করে যখন বহু আরব দেশের কাছে ইরান এখন তাদের চেয়েও বড় শ'ত্রু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে?

লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এল-দাহশান, যিনি নিজে জাতিসংঘে চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলে ছিলেন, তিনি বিবিসিকে এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ফিলিস্তিনিরাই এখন আর দেখছেন না।

তিনি আরও বলেন, ''পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে এখনও প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ইহুদি বসতি তৈরি হচ্ছে। ওই সব বসতিতে ইহুদি জনসংখ্যা ইতোমধ্যে আট লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ওই সব বসতি রক্ষার নামে ফিলিস্তিনি জনবসতির মধ্যে দেয়ালে পর দেয়াল উঠেছে। গাজা ভূখ'ণ্ড এখন একটি কারাগার। এর ফলে ফিলিস্তিনিরা বুঝে গেছে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন হয়তো আর সম্ভব নয়। তাদের নেতারা মুখে না বললেও বাস্তবতা বুঝতে পারছেন।''

ড. নায়েল শামাও মনে করেন, বাদশাহ সালমানের দাবি অনেকটাই অসাড়, কারণ ''আরব শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা এখন সুদুর পরাহত।'' তার মতে, ''আরব বিশ্বের রাজনীতিতে সারবস্তুর চাইতে বাগাড়ম্বর বেশি। ইয়েমেনের যু'দ্ধ, সাংবাদিক জামাল খাসোগের হ'ত্যা আর অর্থনৈতিক স'ঙ্ক'টে সৌদি আরব ইমেজ স'ঙ্ক'টে পড়েছে। দেশের ভেতর এবং বাইরে গ্রহণযোগ্যতা ধ'রে রাখা সৌদি রাজপরিবারের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'' সূত্র : বিবিসি বাংলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে