শুক্রবার, ০২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:৩০:৩৯

বাবরি মসজিদ: সবাই কি ভারতীয় মুসলিমদের পরিত্যাগ করেছে?

বাবরি মসজিদ: সবাই কি ভারতীয় মুসলিমদের পরিত্যাগ করেছে?

সৌতিক বিশ্বাস : সময় লেগেছে তিন দশক। ছিল সাড়ে আটশো সাক্ষী। দেখা হয়েছে সাত হাজারের বেশি দলিলপত্র, ছবি আর ভিডিও টেপ। এত কিছুর পর ভারতের একটি আদালত ষোড়শ শতকের একটি মসজিদ ভে'ঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য কাউকে দো'ষী বলে খুঁ'জে পায়নি। পবিত্র নগরী অযোধ্যায় এই মসজিদটিতে হা'মলা চালিয়েছিল উ'চ্ছৃ'ঙ্খল হিন্দু জনতা।

এই মামলায় যে ৩২ জন জীবিত অ'ভিযু'ক্ত, তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানি এবং আরও অনেক সিনিয়র বিজেপি নেতা। বুধবারের রায়ে এদের সবাইকে খা'লা'স দেয়া হয়েছে। আদালত বলেছে, ১৯৯২ সালে এই মসজিদটি ধ্বং'স করেছে অচেনা 'সমাজ-বিরো'ধীরা' এবং এই হা'মলা পূর্ব-পরিক'ল্পিত ছিল না।

মসজিদটি ধ্বং'স করতে সময় লেগেছিল মাত্র চার ঘন্টা। এই কাজটি করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে। এটি ধ্বং'সের আগে যে এই কাজের মহ'ড়া দেয়া হয়েছে, এতে যে স্থানীয় পুলিশের প্র'চ্ছ'ন্ন সম্মতি ছিল এবং হা'ম'লাকারীদের যে দা'য়মু'ক্তি দেয়া হয়েছিল - এমন বিশ্বা'সযো'গ্য বিবরণ দিয়েছেন অনেক প্রত্য'ক্ষদ'র্শী সাক্ষী। 

তবে তারপরও আদালত এরকম রায় দিয়েছে। গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বলেছিল, এটি ছিল এক ''সুপরিক'ল্পিত ঘ'টনা‌'' এবং ''আইনের শা'সনের এক গু'রুতর ল'ঙ্ঘ'ন‌''। তাহলে অ'ভিযু'ক্তরা যে খা'লাস পেলেন এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? সাধারণভাবে এই রায়কে দেখা হচ্ছে ভারতের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা কতটা ঢিমে-তালের এবং বিশৃ'ঙ্খ'লাপূর্ণ- তারই আরেকটা ন'জির হিসেবে। 

অনেকের আশং'কা, কয়েক দশক ধ'রে বিচার বিভাগের ওপর যেরকম ন'গ্ন রাজনৈতিক হ'স্তক্ষে'প চলেছে, প্রয়োজনীয় তহ'বিল দেয়া হয়নি এবং এর স'ক্ষ'মতা দু'র্ব'ল করা হয়েছে, তাতে এটিকে আর সংস্কার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই রায় একই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ের ওপর তী'ব্র আলোকপাত করেছে- সেটি হচ্ছে কীভাবে ভারতের ২০ কোটি মুসলিমকে ক্র'ম'শই এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হচ্ছে। 

ভারতে নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতী'য়তাবা'দী দল বিজেপির শা'সনে মুসলিমদের কো'ণঠা'সা করে ফেলা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া যে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্র বলে কথিত, তার বহুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে মুসলিমরা এখন ভারতে নিজেদের অনেক বেশি অ'পমা'নিত বলে মনে করে।

গরুর মাংস খাওয়ার কারণে কিংবা গাড়িতে গরু নিয়ে যাওয়ার কারণে মুসলিমদের পি'টিয়ে হ'ত্যা করেছে উ'ন্ম'ত্ত জনতা। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে গরু এক পবিত্র প্রাণী। মোদী সরকার আইনে দ্রুত গতিতে এমন সব সংস্কার এনেছে, যাতে করে প্রতিবেশি দেশগুলোর অমুসলিমরা ভারতে আশ্রয় পায়। ভারতের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু এবং কাশ্মীর তারা কয়েক টু'করো করে ভে'ঙ্গে দিয়েছে। সাংবিধানিক স্বা'য়ত্বশা'সন হ'র'ণ করেছে।

এবছর একটি মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠী দিল্লিতে এক ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন করার পর করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য কেবল মুসলিমদের ওপরই দো'ষ চা'পানো হয়। ম'হামা'রির মধ্যে যখন হিন্দুদের বড় ধর্মীয় সমাবেশ হয়েছে, সেটিকে কিন্তু একই রকমের নি'ন্দা আর স'মালো'চনার মুখে পড়তে হয়নি গণমাধ্যম বা রাজনীতিকদের কাছ থেকে, একইভাবে দো'ষ চাপানোর চেষ্টাও চোখে পড়েনি।

এখানেই শেষ নয়। গত শীত মৌসুমে বিত'র্কিত এক নাগরিকত্ব আইনের বি'রু'দ্ধে দা'ঙ্গায় উ'স্কা'নি দেয়ার ক'থি'ত অ'ভিযো'গে মুসলিম ছাত্র আর কর্মীদের ধ'রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, জেলে ঢো'কানো হয়েছে। অথচ দা'ঙ্গায় উ'স্কা'নি দেয়া অনেক হিন্দু মুক্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। অনেক মুসলিমের মতে, ভারতে মুসলিমদের যেভাবে হে'ন'স্তা করা হচ্ছে, বাবরি মসজিদের ঘ'টনার রায় আসলে তারই ধা'রাবা'হিকতা মাত্র।

ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে এই বি'চ্ছি'ন্নতার বোধ একেবারেই বাস্তব। মোদীর দল তাদের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জো'রের আদর্শ নিয়ে কোন রাখ-ঢাক করে না। জনপ্রিয় টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলগুলো প্রকাশ্যেই মুসলিমদের দা'নবরূ'পে চিত্রিত করার কাজ চলে। ভারতের এক সময়ের অনেক শ'ক্তিশালী আঞ্চলিক দল, যারা তাদের জনগণের পাশে দাঁড়াতো, তারাও যেন মনে হচ্ছে মুসলিমদের পরিত্যা'গ করেছে।

প্রধান বিরো'ধী দল কংগ্রেসের স'মালো'চকরা বলেন, এরা কেবল ভোটের স্বার্থে মুসলিমদের ব্যবহার করে, বিনিময়ে তাদের কিছু দেয় না। আর মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজেদেরও এমন নেতা কমই আছেন, যারা তাদের হয়ে কথা বলবে।

দিল্লি ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা 'সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের' গবেষক আসিম আলি বলছেন, মুসলিমরা এই পুরো ব্যবস্থার ওপর তাদের বিশ্বাস হা'রাচ্ছে। তাদের মনে হচ্ছে তারা কো'ণঠা'সা হয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম- কেউই আসলে মুসলিমদের জন্য কিছু করছে না। সত্যি কথা বলতে কী, ভারতে মুসলিমদের প্রান্তিক জনগো'ষ্ঠিতে পরিণত করার ইতিহাস অনেক দী'র্ঘ। 

একটি রিপো'র্টে বলা হচ্ছে, ভারতে মুসলিমদের একই সঙ্গে দুটি বোঝা বইতে হচ্ছে। একদিকে তাদের ''দেশ বিরো'ধী'' বলে ত'ক'মা দেয়া হয়, আবার একই সঙ্গে বলা হয় ভারতে ''মুসলিম তো'ষণ'' চলছে। কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলছেন, এখানে পরি'হাসের বিষয় হচ্ছে, মুসলিমরা অন্যা'য্য সুবিধে পাচ্ছে- হিন্দু জাতী'য়তাবা'দীদের এরকম কথা অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করছে। বাস্তবে ভারতের মুসলিমরা কোন ধ'রণের আর্থ-সামাজিক অ'গ্রগ'তি অর্জন করেনি।

ভারতের বড় বড় নগরীগুলিতে মুসলিমদের ক্রমাগত বেশি হা'রে কিছু নির্দিষ্ট মহল্লায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ভারতের সবচেয়ে সুসজ্জিত পুলিশ বা'হি'নী, ফে'ডারেল পুলিশ বা'হি'নীতে ২০১৬ সালে মুসলিম পুলিশ অফিসার ছিল ৩ শতাংশেরও নীচে। অথচ মুসলিমরা ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ। একটি রিপো'র্টে বলা হয়, ভারতের শহুরে মুসলিম জ'নগো'ষ্ঠির মাত্র ৮ শতাংশ এমন কাজ করেন যেখানে নিয়মিত বেতন মেলে। এটি ভারতের জাতীয় গড় হারের তুলনায় অনেক কম।

প্রাথমিক স্কুলগুলোতে মুসলিম শিশুদের ভর্তির হার যদিও বেশ উঁচু, কিন্তু হাইস্কুলে যেতে যেতে এরা ঝ'রে পড়ে। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক ব'ঞ্চ'না। ভারতের পার্লামেন্টে মুসলিমদের প্রতিনি'ধিত্ব ক্র'মাগত কমছে। পার্লামেন্টের নির্বাচিত নিম্নকক্ষে এখন মুসলিম সদস্য ৫ শতাংশের নীচে। অথচ ১৯৮০ সালে এটি ছিল ৯ শতাংশ। ২০১৪ সালে যখন বিজেপি ক্ষমতায় এলো, তখন তাদের একজনও মুসলিম এমপি ছিল না। 

ভারতের ইতিহাসে একজনও মুসলিম এমপি ছাড়া কোন দলের ক্ষ'মতায় আসার সেটাই প্রথম ঘ'টনা। মোদী এবং তার দলের নেতারা সবসময় দাবি করে চলেছেন যে তারা কোন ধর্মের বি'রু'দ্ধে বৈ'ষ'ম্য করেন না। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলে থাকেন, তার পেছনে অনেক মুসলিম দেশের সমর্থন আছে। তার সরকারের যে ব্যা'পক জনকল্যাণ কর্মসূচি, সেটির সুফল সব দরিদ্র ভারতীয়ের কাছেই পৌঁছাচ্ছে। তারা যে জাতের বা যে ধর্মের মানুষই হোক না কেন।

বিজেপি বরং উদারপ'ন্থী বি'রো'ধী দলগুলোকে ''ধর্মনি'রপে'ক্ষতার ভে'কধা'রী'' বলে বর্ণনা করে থাকে। অনেকে মনে করেন, বিজেপির এই অ'ভিযো'গ কিছুটা সত্য। এর উ'দাহা'রণ হিসেবে তারা কমিউনিস্টদের দিকে ইঙ্গিত করেন, যারা তিন দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গ শা'সন করেছে। কমিউনিস্টরা স্প'ষ্টভাষায় নিজেদের ধ'র্মনি'রপেক্ষ বলে দাবি করে। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ হচ্ছে মুসলিম। কমিউনিস্টরা তাদের নি'রা'পত্তা এবং সু'র'ক্ষার নি'শ্চ'য়তা দিয়েছিল।

অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, গুজরাটের মুসলিমরা অর্থনৈতিকভাবে এবং মানব উন্নয়ন সূচকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিদের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। যদিও গুজরাটে সা'ম্প্রদা'য়িক রাজনীতি চলে, সেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে উত্তে'জনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপি যে ধ'রণের ধ'র্মভি'ত্তিক নির্বাচনী রাজনীতির চর্চা করে, তাতে করে মুসলিমদের ''আলাদাকরণ'' করা হয়েছে।

তবে ভারতের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মির্জা আসমের বেগ এটিকে ব্যাখ্যা করছেন এভাবে, "ভারতের বাজার অর্থনীতির কোন ধর্ম নেই। কাজেই গুজরাটের মতো রাজ্য, যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ভালো, সেখানে হিন্দু এবং মুসলিম, উভয়েই ভালো উপার্জন করছে।"

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফে জাফরেলট বলেন, "কিভাবে আপনি মেরুকরণের কাজটা করবেন? এটা আপনি করবেন অন্যদেরকে আপনার পরিচয়ের প্রতি একটা হু'মকি হিসেবে চিত্রিত করে। ভারত এখন এক ধরণের ''এথনিক ডে'মোক্রে'সির'' দিকে যাচ্ছে, যা এথনিক জাতী'য়তাবা'দ থেকে উৎ'সা'রিত। এর মূলে আছে এ'কধ'রণের ''শ্রেষ্ঠত্বের'' বোধ।

তবে সবকিছু এখনো অ'ন্ধ'কারে হা'রিয়ে যায়নি। এক তরুণ ম'ধ্য'বিত্ত গোষ্ঠির উ'ত্থা'ন ঘ'টছে, দেশভাগের ভূত যাদের ঘাড়ে চে'পে নেই। নাগরিকত্ব আইনের বি'রু'দ্ধে যে ব্যা'পক বি'ক্ষো'ভ হয়েছিল, তখন সেখানে এই তরুণ, স্প'ষ্টভা'ষী মুসলিম নারী-পুরুষদের দেখা গেছে ভারতের রাস্তায়। ভারতীয় মুসলিম সম্প্র'দায় এক ঘরকুনো এবং নি'র্বা'ক সংখ্যাল'ঘু বলে যে গৎবাঁ'ধা ছবি, সেটা তারা ভে'ঙ্গে দিয়েছে।

এলাকায় এলাকায় এখন গড়ে উঠেছে কমিউনিটি কোচিং ক্লাস। সেখানে তরুণ মুসলিমদের ভারতের ম'র্যা'দাপূর্ণ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জহির আলি বলছেন, ভারতের অনেক তরুণ মুসলিম এখন তাদের মুসলিম পরিচয়কে ই'তিবা'চক হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা তাদের মত প্রকাশে মোটেই কু'ন্ঠি'ত নয়।

তার মতে, শেষ পর্যন্ত বাবরি মসজিদ ধ্বং'সের মামলায় অ'ভিযু'ক্তদের খা'লা'স দেয়ার এই ঘ'ট'না ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে উৎ'ক'ন্ঠা এবং অবি'চারের বো'ধ আরও গভীর করবে। বলছেন, "অনেক দিক থেকেই, এটা আসলে পুরো সম্প্রদায়কে পরিত্যা'গ করার সামিল। তাদের মধ্যে একধ'রণের ''ক্ষমতাহী'নতার'' বোধ তৈরি হচ্ছে। বহু বছর ধ'রে মুসলিমদের তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের নেতারা, হিন্দু নেতারা এবং সব রাজনৈতিক দল কেবল নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করেছে। দারিদ্র তাদের অবস্থাকে আরও শো'চ'নীয় করে তুলেছে।" সূত্র : বিবিসি বাংলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে