বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২০, ০৬:৪৪:০৪

ট্রাম্পের পর ইরানের বিষয়ে জো বাইডেন যা করতে পারেন

ট্রাম্পের পর ইরানের বিষয়ে জো বাইডেন যা করতে পারেন

পল অ্যাডামস : যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, "আন্তর্জাতিক সমঝোতার রীতি নীতি ভেঙে পড়ছে।" তিনি আমেরিকার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছেন এবং বলেছেন যে সেই কাজটা তিনি খুব দ্রুতই করবেন।

"নষ্ট করার মতো সময় নেই," এবছরের শুরুর দিকে পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক এক সাময়িকীতে একথা লিখেছেন জো বাইডেন। এধরনের বিষয়ে কাজের যে লম্বা তালিকা জো বাইডেনের হাতে রয়েছে তার একটি হচ্ছে ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তিতে পুনরায় যোগ দেওয়া। জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন বা জেসিপিওএ নামের এই চুক্তিটি সই হয়েছিল ২০১৫ সালে।

এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করা। এতে সই করেছিল ইরান, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ- চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জার্মানি এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্বসূরি বারাক ওবামার শাসনামলের অন্যতম সাফল্য হিসেবে দেখা হয় এই সমঝোতাকে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর পরই এই চুক্তিটি বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বাকি পক্ষগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের মে মাসে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটুকু করেই থেমে থাকেন নি, পুরো চুক্তিটি ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যেও সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন।

পরের দু'বছর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ দিয়ে গেছেন। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কিন্তু তারপরেও ইরানকে দমানো সম্ভব হয়নি। বরং তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য যেসব প্রযুক্তি প্রয়োজন সেগুলো অর্জনের আরো কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর জো বাইডেন কি পরিস্থিতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন? বর্তমান সময় এবং আমেরিকার বিভক্ত রাজনীতির মধ্যে তার পক্ষে কি সেটা করা সম্ভব হবে? "তার কৌশল খুব পরিষ্কার। কিন্তু সেটা করা সহজ হবে না," বলেছেন রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের ইরান বিশেষজ্ঞ আনিসে বাসিরি তাবরিজি।

ফিরে যাওয়া নয় : গত দু'বছর ধরে ইরানের ওপর যেসব নিষে'ধা'জ্ঞা আরো'প করা হয়েছে সেগুলো থেকে জো বাইডেন বাড়তি কিছু সুবিধা পেতে পারেন, যদি তিনি সেগুলো অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এবিষয়ে এখনও তিনি কোন মন্তব্য করেন নি। শুধু বলেছেন চুক্তি অনুসারে ইরানকে কোন কোন বিষয় মেনে চলতে হবে। 

জানুয়ারি মাসে জো বাইডেন লিখেছিলেন, "তেহরানকে চুক্তিটি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।" কিন্তু ইরানকে সেটা করতে বাধ্য করানোও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের বের হয়ে যাওয়ার পর ইরান তার নিজের কাজে ফিরে যেতে শুরু করেছে।

পরমাণু কর্মসূচির ওপর নজর রাখে জাতিসংঘের যে সংস্থাটি সেই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ তাদের শেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে চুক্তিতে ইরানকে যতোটুকু ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তারা তার চেয়েও ১২ গুণ বেশি ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছে।

সংস্থাটি এও বলেছে ইরানকে যে মাত্রায় (৩.৬৭%) ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তারা তারচেয়েও বেশি মাত্রায় সমৃদ্ধ করার কাজ শুরু করেছে। অল্প মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বেসামরিক নানা কাজে ব্যবহার করা হয় কিন্তু এর বিশুদ্ধতার মাত্রা বেশি হলে সেটা পরমাণু বোমা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতে পারে আর সেটা নিয়েই পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ।

তবে, ইরানের কর্মকর্তারা বার বার বলছেন, প্রয়োজন হলে তারা আবার পুরনো চুক্তিতে ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু কথা হল এর মধ্যে তারা গবেষণায় যে অগ্রগতি ঘটাবে সেটা তো আর মুছে ফেলা যাবে না। "আমরা তো পেছনে যেতে পারবো না, এখন আমরা একটা পয়েন্ট থেকে আরেকটা পয়েন্টে পৌঁছে যাচ্ছি এবং আমরা এখন এই জায়গাতেই আছি।" বলেন আলী আসগর সুলতানিয়েহ, জাতিসংঘের পরমাণু বিষয়ক সংস্থায় ইরানের সাবেক দূত।

রাজনৈতিক চাপ : এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঝড় সামাল দিয়েছে ইরান। এখন তাদের নিজেদেরও কিছু দাবি আছে। ইরানি কর্মকর্তারা বলছেন, যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে শুধু নিষে'ধা'জ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়াই যথেষ্ট হবে না। ইরান আশা করছে, আড়াই বছরের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের যেসব অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে সেটা পুষিয়ে নিতে তাদেরকে ক্ষতিপূরণও দিতে হবে।

ইরানে আগামী বছরের জুন মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তার আগে সংস্কারবাদী ও কট্টরপন্থী শিবিরগুলো এবিষয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরতে শুরু করেছে। ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। এখন নিষে'ধা'জ্ঞা শিথিল করার মাধ্যমে জো বাইডেন কি প্রেসিডেন্ট রুহানির সম্ভাবনা চাঙ্গা করার চেষ্টা করবেন?

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নাসের হাদিয়ান-জ্যাজি বলেছেন, দায়িত্ব গ্রহণের আগেই জো বাইডেনকে এবিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আনুষ্ঠানিক বার্তা দিয়ে তাকে বলতে হবে কোন ধরনের শর্ত ছাড়াই খুব দ্রুত তিনি জেসিপিওএ চুক্তিতে ফিরে যাবেন। এটুকুই যথেষ্ট হবে।

তিনি বলেন, বাইডেন যদি এটা করতে ব্যর্থ হন তাহলে ইরান, যুক্তরাষ্ট্র এবং ওই অঞ্চলের ষ'ড়য'ন্ত্রকারীরা চুক্তির বিষয়ে এই দুটো দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুন-প্রতিষ্ঠায় সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে জো বাইডেনের এখানে কিছু করার ক্ষমতা হয়তো সীমিত। জেসিপিওএ চুক্তির পক্ষে বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে দলীয় অবস্থান পুরোপুরি বিভক্ত। বেশিরভাগ রিপাবলিকান এই চুক্তির বিরোধী।

এছাড়াও ওয়াশিংটনে ক্ষমতার ভারসাম্য কী হবে এবং নতুন প্রশাসন কতোটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে সেটা জানুয়ারি মাসে সেনেটের বাকি নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে। জেসিপিওএ চুক্তিটি কখনো কোন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ছিল না। এর সঙ্গে আরো যেসব দেশ যুক্ত রায়েছে- রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের ভূমিকা রয়েছে এর ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে।

বিশেষ করে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইউরোপের দেশগুলো এনিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেও চুক্তিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। ফলে এই তিনটি দেশ চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় ফিরে আসার সমঝোতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

তবে লন্ডন, প্যারিস এবং বার্লিনে অনেকেই মনে করছেন বিশ্ব পরিস্থিতি আর আগের জায়গাতে নেই এবং পুরনো চুক্তিতে যে খুব সহজেই ফিরে যাওয়া যাবে সেই সম্ভাবনা কম। আনিসে বাসিরি তাবরিজি বলেন, "ইউরোপের তিনটি দেশ এখন জেসিপিওএ চুক্তির পরবর্তী সমঝোতার ওপর জোর দিচ্ছে।" 

তিনি বলেন, এরকম কোন চুক্তি হলে ইরানের আঞ্চলিক তৎপরতা এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করাসহ দেশটির পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করে দেওয়ার জন্যেই সেটা করা হবে। কারণ বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিছু আঞ্চলিক শক্তি, যারা জেসিপিওএ চুক্তির বিরোধিতা করেছিল, যেমন ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন- তারা সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য কিছু চুক্তিতে সই করেছে।

এসব সমঝোতা হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায়। ফলে এসব দেশ কী চায় সেটা উপেক্ষা করাও এখন কঠিন হবে। সম্প্রতি তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে ওয়াশিংটনে আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল-ওতাইবা বলেছেন, "আমরা যদি আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপার নিয়ে সমঝোতা করতে চাই তাহলে আমাদেরকে সেখানেও যেতে হবে।"

তার এই কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে ওই ইন্সটিটিউটের পরিচালক আমোস ইয়াদলিনের কথাতেও। তিনি বলেছেন, "মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের অন্যান্য মিত্রদের সাথে নিয়ে ইসরায়েলও ওই আলোচনায় থাকতে চায়।" সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানও ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

এসব মতামত ও অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে ইরানের সঙ্গে করা চুক্তিতে ফিরে যাওয়া নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্যে খুব একটা সহজ হবে না। সব পক্ষের চাওয়া পাওয়া একসাথে মেলানোর কূটনীতি তার জন্য রুবিক্স কিউব মেলানোর মতোই কঠিন হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে গত সপ্তাহে ট্রাম্প ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আক্রমণের বিষয়টি নিয়ে তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু উপদেষ্টারা তাকে এই কাজ করা থেকে বিরত রেখেছেন। কিন্তু নির্বাচনে পরাজয়ের পরেও আন্তর্জাতিক রীতি নীতি উপেক্ষা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন এবং আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিচ্ছেন।

তবে জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আগে ট্রাম্প যা কিছুই করুন না কেন এটা পরিষ্কার: জো বাইডেনের জন্যে তিনি পরিস্থিতি আরো কঠিন করে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। ফলে এই সময়ের মধ্যে ইরানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। সূত্র : বিবিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে