ইতিহাসের কাঠগড়ায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক, তিক্ততা বেড়ে প্রক্সি যুদ্ধে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইতিহাসের কাঠগড়ায় সৌদি আরব-ইরান সম্পর্ক। ১৯৭৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যে দেশ দু'টির মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। সেই তিক্ততা এখন রূপ নিয়েছে প্রক্সি যুদ্ধে। তার মধ্যে সৌদিতে শিয়া শীর্ষ নেতা শেখ নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
শেখ নিমরের শিরোশ্ছেদের ঘটনায় ইরানের রাজধানী তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলার জের ধরে দেশটির সঙ্গে সব ধরণের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে সৌদি আরব। অন্যদিকে ইরানের শীর্ষ শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ আল-খামেনি বলেন, শেখ নিমরের শিরোশ্ছেদের অপরাধে সৌদিকে ‘ঐশ্বরিক প্রতিশোধের’ সম্মুখীন হতে হবে।
দু’দেশের মধ্যে এ দ্বন্দ্বগুলো সাম্প্রতিক হলেও সম্পর্কের টানাপোড়েন চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। গত দু’দশকে ইরান-সৌদির পারস্পরিক সম্পর্কের চিত্র দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১৯৭৯: ইরান বিপ্লব: সৌদি শাসকরা তখন হতভম্ব হয়ে দেখেছিলেন শিয়া ধর্মীয় নেতাদের ব্যাপক বিদ্রোহের মুখে ইরানের তৎকালীন শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভির পতন। সৌদির শাসকদের বিশ্বাস ছিলো শিয়া নেতারা এই বিদ্রোহ তাদের দেশেও ছড়াতে বদ্ধপরিকর।
১৯৮০-১৯৮৮: ইরান-ইরাক যুদ্ধ: ইরান ও ইরাকের মধ্যকার ওই যুদ্ধে ইরাক রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিলো। সেই যুদ্ধে সৌদি আরব ইরাকের পক্ষ নেয়ায় ফুঁসে উঠেছিলো ইরান।
১৯৮৭: মক্কায় সংঘাত: সৌদি আরব-ইরান সম্পর্ক ১৯৮৭’র জুলাইয়ে প্রায় ভাঙতেই বসেছিলো। ওই সময় মক্কায় এক সংঘর্ষে ৪০২ হাজি নিহত হন, যাদের মধ্যে ২৭৫ জনই ছিলেন ইরানি। ওই ঘটনায় তেহরান জুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে।
বিক্ষোভকারীরা তেহরানে সৌদি দূতাবাসের দখল নেয় এবং কুয়েত দূতাবাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে দূতাবাসের জানালা থেকে বাইরে পড়ে মুসাদ আল-ঘামদি নামের এক সৌদি কূটনীতিক নিহত হন। রিয়াদের অভিযোগ ছিলো তেহরান ঘামদিকে সৌদি আরবের হাসপাতালে স্থানান্তর করতে দেরি করেছিলো বলেই তার মৃত্যু হয়েছে।
১৯৮৮’র এপ্রিলে সৌদি বাদশাহ ফাহাদ ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
১৯৯৭: সম্মেলন: ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ইরানে আয়োজিত এক ইসলামিক সম্মেলনে অংশ নেন তৎকালীন সৌদি যুবরাজ আবদুল্লাহ। ইরান বিপ্লবের পর ওই প্রথম অত উচ্চ পদমর্যাদার কেউ ইরানে পা রাখেন।
১৯৯৯-২০০১: ভালো সময়: ইরান বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি সৌদি সফরের যান। ইরানের অন্যতম প্রধান শিয়া নেতা প্রেসিডেন্ট খাতামি সে সময় থেকে সৌদির সঙ্গে চলমান বিবাদ মিটমাটের চেষ্টা করতে থাকেন।
২০০১-এ সৌদি বাদশাহ ফাহাদ প্রেসিডেন্ট খাতামিকে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এটি খাতামির সংস্কারমূলক নীতিমালার পক্ষে এক ধরণের সমর্থন। ২০০১’র এপ্রিলে দেশ দু’টির মধ্যে একটি নিরাপত্তা চুক্তি সই হয়।
২০০৩: আঞ্চলিক বিরোধ: ইরাকে সাদ্দাম শাসনের পতন দেশটির শিয়া জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতাশালী করে তোলে। এর ফলে ইরাকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ইরানের পক্ষে চলে যায়। এর মধ্যে ইরানের নিউক্লিয়ার শক্তি প্রকল্প সৌদি আরবের শাসকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। তারা ভাবতে থাকেন, প্রেসিডেন্ট খাতামির উত্তরসূরি মাহমুদ আহমেদিনেজাদ উপসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার এবং শিয়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছেন।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সৌদি আরব এক ইরানি কূটনীতিককে সতর্ক করে বলে, ইরাক এবং নিউক্লিয়ার প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ইরান পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলকেই বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
২০১১: আরব বসন্ত বিপ্লব: বাহরাইনে গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভকারীদের দমনে বাহরাইন সরকারকে সাহায্য করতে সৌদি আরব এ সময় সশস্ত্র বাহিনী পাঠায়। তাদের ভয় ছিলো বিক্ষোভকারী এবং বিরোধীরা (অধিকাংশই শিয়া) ইরানের পক্ষে চলে যাবে। বাহরাইন ও সৌদি মিলে অভিযোগ আনে, বাহরাইনি পুলিশের বিরুদ্ধে সহিংসতার আগুনে ঘি ঢালছে ইরান।
উইকিলিকস প্রকাশিত মার্কিন তারবার্তায় দেখা যায়, বাদশাহ আবদুল্লাহসহ অন্যান্য সৌদি নেতারা ইরানের নিউক্লিয়ার প্রকল্পের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে ওয়াশিংটনকে বারবার চাপ দিয়েছেন। এমনকি প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথাও বলেন তারা।
সৌদি সরকার শেখ নিমরসহ আরো কয়েকজন শিয়া নেতার বিরুদ্ধে দেশের বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তির (ইরান) সহযোগিতা করার অভিযোগ আনে।
এ সময় ওয়াশিংটন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত হত্যার জন্য ইরানের একটি পরিকল্পনা উন্মোচন করেছে তারা। এর উত্তরে রিয়াদ জানায়, তেহরানের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে এবং এ পরিকল্পনার জন্য দেশটিকে মূল্য দিতে হবে।
২০১২: প্রক্সি যুদ্ধ: ইরানের মিত্র সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার সংগ্রামে বিদ্রোহীদের প্রধান সমর্থক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে সৌদি আরব। রিয়াদ আসাদকে ‘গণহত্যা’ চালানোর জন্য দায়ী করে এবং ইরানকে ‘দখলদার শক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। অন্যদিকে তেহরান রিয়াদকে ‘সন্ত্রাসে’ সমর্থন দেয়ার অভিযোগ তোলে।
২০১৫’র মার্চে ইয়েমেনে হাউদি বিদ্রোহীদের রুখতে সৌদি সামরিক অভিযান শুরু করে। হাউদির শক্তি হিসেবে কাজ করছিলো ইরান। সৌদির অভিযোগ, ইরান ইয়েমেনে অভ্যুত্থান ঘটাতে মিলিশিয়া বাহিনী ব্যবহার করছে। ওদিকে তখন রিয়াদ সাধারণ মানুষদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাচ্ছে বলে দাবি করে তেহরান। সূত্র: চ্যানেল আই
০৪ জানুয়ারি ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএস
�