দেয়াল উঠছে ইউরোপের দেশে দেশে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গ্রীসের লেসবস দ্বীপে সাগর পাড়ে ছোট একটি হোটেল চালান আফ্রোদাইতি ভাতি মারিয়ালা। কিন্তু ব্যবসা নিয়ে এখন চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তিনি। গত প্রায় এক বছর ধরে প্রতিদিন রাবারের ডিঙ্গি ভরে ভরে শ'য়ে শ'য়ে যেভাবে অভিবাসী এসে নামছে, তাতে পর্যটকদের আনাগোনা একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। ‘চিন্তা করুন, আপনি এখানে বসে লাঞ্চ সারলেন, তারপর সাতার কাটতে সাগরে নামলেন। হঠাৎ কেউ চিৎকার করে উঠলো সরে যান সরে যান, নৌকা আসছে। ছুটি কাটাতে এসে কেমন লাগবে আপনার তখন।’ বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা যায়।
‘বিষয়টি খুবই আবেগের। যখন আপনি দেখবেন, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে উদভ্রান্ত নারী পুরুষ নৌকা করে এসে নামেছ, বাচ্চাগুলো ভয়ে কাঁদছে- আপনি তখন বসে থাকতে পারবেন না। কিন্তু আমার ব্যবসার তো মাথায় বাড়ি।’
পুরো ২০১৫ সাল ধরে এভাবে প্রতিদিন সিরিয়া সহ এশিয়া ও আফ্রিকার যুদ্ধ বিগ্রহে বিপর্যস্ত কয়েকটি দেশ থেকে তুরস্ক থেকে ইউরোপে আশ্রয়ের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ এই দ্বীপে এসে নেমেছে। এখনও নামছে।
জাতিসংঘের হিসাবে ২০১৫ সালে দশ লাখেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপের মাটিতে এসে নেমেছে। তাদের ৯৫ শতাংশই এসেছে নৌকা করে। সিংহভাগই লেসবস ও কোস সহ গ্রীসের কয়েকটি দ্বীপে।
তারপর গ্রীস থেকে বাসে, ট্রেনে, মহাসড়ক এমনকি ফসলের ক্ষেতে ধরে পশ্চিম এবং উত্তর ইউরোপ মুখী হাজার হাজার অভিবাসীর কাফেলা ইউরোপ জুড়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
এতটাই আতঙ্ক যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠছে এখন।
'আমূল বদলে যেতে পারে ইউরোপ'
স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিরো সিরার সম্প্রতি বলেছেন, ‘ইউরোপ এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। কোন সমাধানে যদি দ্রুত একমত না হওয়া যায়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধ্বংসের সূচনা হবে।’
যে সমাধানের কথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপেক্ষাকৃত নতুন এই দেশটির নেতা বলছেন তা হলো, কিভাবে ইউরোপে অভিবাসীর এই স্রোত ঠেকানো যাবে, তার একটি রাস্তা খুঁজে বের করা।
কিন্তু এক বছরেও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কোনও ফরমুলা ব্রাসেলস থেকে বের করা যায়নি। এমনকি যে দশ-এগার লাখ মানুষ গত এক বছরে ঢুকেছে, তাদের দায়িত্ব কে কতটা নেবে, তা নিয়েও কোনও ঐক্যমত্য হচ্ছেনা।
তার ফলে, একের পর এক দেশ, বিশেষ করে অভিবাসীরা যে রুট নিয়ে চলছে, তারা তাদের মত করে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। হাঙ্গেরি এবং মেসিডোনিয়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া উঠিয়ে অভিবাসীর স্রোত আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
পরিস্থিতি দেখে ইউরোপের শীর্ষ নীতি নির্ধারণী পরিষদ ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক অভিবাসী সমস্যার পরিণতি নিয়ে তার উদ্বেগ ঢেকে রাখেননি। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, অভিবাসী সঙ্কট ইউরোপকে বদলে দিতে পারে।
‘যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমরা গড়েছি, শরণার্থী সমস্যার কারণে তা যে বদলে যেতে পারে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অভাবনীয় যে সব সাফল্য, যেমন শেঙ্গেন দেশগুলোর মধ্যে সীমান্তে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই যে চলাচল তা বরবাদ হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় চিন্তা হচ্ছে, এই সমস্যার কারণে ইউরোপের রাজনীতির মানচিত্র আমূল বদলে যেতে পারে।’
ইউরোপের ২৬টি দেশের মধ্যে পাসপোর্ট ছাড়া অবাধে চলাচলের লক্ষ্যে শেঙ্গেন নামে যে চুক্তি ১৯৯৫ তে হয়েছিল সেটি দৃশ্যতই এখন ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ার জোগাড় হয়েছে। অথচ শেঙ্গেন চুক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়ামের পরে এ সপ্তাহেই সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে সুইডেন ও ডেনমার্ক।
গত বিশ বছর ধরে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন এবং সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর মালমোর মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তা সম্ভব হয়েছে শেঙ্গেন চুক্তির জন্য।
এক শহরের মানুষ সাগরের ওপর দিয়ে তৈরি আট কিলোমিটার লম্বা একটি সেতু পার হয়ে অন্য শহরে গিয়ে কাজ করে সন্ধ্যায় ফিরে যান।
কিন্তু বিশ বছর পর এখন তারা তারা বুঝতে পারবেন যে তারা ভিন্ন দুই দেশের বাসিন্দা। পকেটে পাসপোর্ট রাখতে হবে। ইমিগ্রেশনের জন্য গাড়ির লাইন ধরতে হবে।
এই দুই শহরের বাসিন্দারা ভয় পাচ্ছেন, সীমান্তে পাহারা বসার পর সেতু পারাপারে সময় বেড়ে যাবে। ফলে, এক শহরে থেকে আরেক শহরে গিয়ে কাজকর্ম করা এখন কঠিন হয়ে পড়বে।
উদ্বেগ বাড়ছে শরণার্থীর চাপে কি তাহলে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আবার দেয়াল উঠতে শুরু করেছে?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর গবেষণা সংস্থা ওপেন ইউরোপের কর্মকর্তা নিনা শিক বলছেন এখনও ইউরোপের নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, এসব পদক্ষেপ অস্থায়ী। ‘তবে ইউরোপে অবাধে চলাফেরা সুবিধা প্রচণ্ড হুমকিতে পড়েছে সন্দেহ নেই।’
নিনা শিক বলেন, এই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ অভিবাসীরা ইউরোপে ঢুকে প্রথমেই সেসব দেশে যেতে চাইছে যারা শরণার্থীদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উদার -- জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন।
‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেষ্টা করছে জোটের সমস্ত দেশগুলো যেন শরণার্থীদের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। আর তা নিয়েই বেধেছে সমস্যা। অনেক দেশই তা মানতে চায়না।’
তৈরি হচ্ছে ইউরোপীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী
শেঙ্গেন চুক্তি অর্থাৎ ইউরোপের ভেতর অবাধ চলাচল অব্যাহত রাখতে এখন পরিকল্পনা হয়েছে যৌথভাবে শেঙ্গেন চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সীমান্ত পাহারা দেওয়ার। একটি ইউরোপীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু লেসবসের হোটেল ব্যবসায়ী আফ্রোদাইতি মারিয়ালা ভরসা পাচ্ছেন না। "সাগরে রাবারের ডিঙ্গিতে মহিলা-শিশুদের কি তারা ফিরিয়ে দেবে বা ডুবিয়ে দেবে?"
সীমান্তে পাহারা বাড়িয়ে দিলেই যে অভিবাসনের স্রোত বন্ধ করা যাবে, তা নিয়ে ইউরোপের ভেতরে যেমন অনেকেই সন্দিহান, তেমনই সন্দিহান জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান আন্তোনিও গুতেরেজ।
‘আমরা ইউরোপে যা দেখছি তা একটি গভীর সমস্যার উপসর্গ মাত্র। প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত মানুষ একসাথে তাদের দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। কারণ, পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহের নাটকীয় প্রসার ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেই সংঘাত নিরসনের বা সংঘাত এড়ানোর সক্ষমতা হারিয়েছে।’
যে যুদ্ধ বিগ্রহের কথা মি গুতেরেজ বলছেন, তা যে অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হবে বা প্রশমিত হবে তার কোনও লক্ষণই নেই।
বরঞ্চ সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সর্বশেষ যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক অশান্তির আশঙ্কা করছেন অনেকেই। তার অর্থ, লেসবস বা কোসের সৈকতে রাবারের ডিঙ্গি করে শরণার্থীদের স্রোতও হয়ত অব্যাহত থাকবে।
তা যদি হয়, তাহলে কয়েক দশক ধরে ইউরোপে যে ইর্ষর্ণীয় সমাজ, রাজনীতি, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে তা সমূলে নাড়া খাবে।
৭ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই
�