সোমবার, ০২ আগস্ট, ২০২১, ০৯:৪৮:৩০

তুরস্কে একই সময়ে ২১টি প্রদেশে আগুন, ষড়যন্ত্র ও অশনি সংকেত

তুরস্কে একই সময়ে ২১টি প্রদেশে আগুন, ষড়যন্ত্র ও অশনি সংকেত

সরোয়ার আলম, তুরস্ক থেকে : গত চার দিন ধরে দাবানলে জ্বলছে তুরস্ক। দেশটির এক চতুর্থাংশ প্রদেশে অর্থাৎ ২১ টি প্রদেশে প্রায় একই সময়ে আগুন লাগে গত বুধবার দুপুরের দিকে। এইসব প্রদেশের বেশিরভাগই পর্যটন এলাকা। এই এলাকাগুলোর বন-জঙ্গলে প্রায় ১১০ জায়গায় জ্বলে উঠে আগুন। শুকনো খরপাতা আর কাঠে ধরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আগুন। 

বাতাসের সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে যায়। আগুন নেভাতে বিভিন্ন শহর থেকে দমকল বাহিনী পাঠালেও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় তারা। সঙ্গে যোগ দেয় হেলিকপ্টার, বিমান এবং ড্রোন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার কাছে তারা হয়ে পড়ে অসহায়। জ্বলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বনজঙ্গল পেরিয়ে আগুন চলে আসে লোকালয়ে। মানুষের ঘর বাড়ি, দোকান পাঠ পুড়ে ছাই করে দেয় আগুন। ওইসব এলাকায় দেখা যায় মানুষের আহাজারি। কেউ সরকারকে দোষ দিচ্ছে। কেউ বলছে ঘণ্টার পড় ঘণ্টা আগুন জ্বললেও দমকল বাহিনী পৌঁছেনি তাদের কাছে।

আগুন নেভাতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিমান ড্রোন হেলিপকপ্টার এবং দমকল বাহিনী। অনেক এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিন্তু এখনও ৪ টা প্রদেশের প্রায় ১০ টা পয়েন্টে এই আগুন জ্বলছে। হয়তো এই আগুন অস্ট্রেলিয়ার মত মাসের পর মাস জ্বলবে না। অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আসছে বাকিটাও আসবে। কিন্তু এই দাবানল অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

১। কেন এই আগুন লাগলো। কিভাবে লাগলো? ২। এই আগুন নিভাতে এতো দেরই হলো কেন? ৩। এর ক্ষয়ক্ষতি কেমন? ৪। এগুলো কি স্বাভাবিক কোন আগুন নাকি কোন নাশকতা, ষড়যন্ত্র আছে। ৫। যদি কোন ষড়যন্ত্র থাকেই তাহলে কে বা কারা এর পিছনে? ৬। এতো বড় একটা ষড়যন্ত্র হলো অথচ তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা কি করলো? ৭। এই দাবানলের জন্য কে দায়ী? তার বা তাদের শাস্তি হবে কি না? ৮। কোনো কোনো দেশ সহমর্মিতা জানিয়েছে। ৯। সমালোচনাগুলো কি কি?

গত বুধবার দুপুরের দিকে শুরু হয় এই দাবানল প্রায় একই সময়ে কয়েকটা জায়গায় শুরু হয় এই দাবানল। তুরস্কে গ্রীষ্মকালে জঙ্গলে আগুন লাগার ঘটনা নতুন কিছু না। প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো জঙ্গলে আগুন লাগে। কখনও জঙ্গলে বারবিকিউ এর কয়লা থেকে, কখনও সিগারেটের গোরা থেকে, কখনও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে আবার অনেক সময় গরমে বাতাসে গাছে গাছে ঘর্ষণ লেগেও আগুন ধরতে পারে বনে জঙ্গলে।

কিন্তু একই সময়ে ২১ টা প্রদেশে প্রায় ১১০ টি জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা বিরল। তাও আবার প্রায় সবগুলোই পর্যটন এলাকা। তুরস্কের সব গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকার জঙ্গলে লাগে এই আগুন। বাতাসের প্রচণ্ড গতিতে দ্রুত ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। আগুন আসতে থাকে লোকালয়ে। প্রথম তেমন গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে আগুনের ভয়াবহতায় টনক নড়ে সরকারের এবং সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের।

এই আগুনগুলো যেসব এলাকায় লেগেছে সেগুলোর প্রায় সব সিটি মেয়র বা উপজেলা চেয়ারম্যান বিরোধী দল থেকে। তাই ধারণা করা হয়, শুরুতে সরকার এগুলো নেভানোর কাজে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। যদিও সরকার এগুলোকে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বলছে। তবে আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে সকলের টনক নড়ে। তখন একের পর এক দাবানলের খবর আসতে থাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে। দেশের চার ভাগ্যের এক ভাগ প্রদেশে দাবানল জ্বলছে। দ্রুত ধেয়ে আসছে লোকালয়ে।

তাই সরকারই বেসরকারি, ক্ষমতাসীন বিরোধী সবাই এক হয়ে আগুন নিভানোর কাজ শুরু করে। কিন্তু এত বিশাল বিশাল জঙ্গলের আগুন নিভানো চাট্টিখানি কথা না। অনেক জায়গায় জঙ্গলের একেবারে ভেতর পর্যন্ত দমকল বাহিনীর পৌঁছা সম্ভব না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনি হয়তো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নিয়ে কোন একটা পথঘাট বের করে ভিতরে ঢুকলেন কিন্তু পরে আপনার বেরোনোর পথে ছড়িয়ে পড়ল আগুন। চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে পারে এবং তখন আরও বড় ক্ষতির সম্ভবনা আছে।

তাই দাবানল বন্ধে সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হলো উপর থেকে পানি দেওয়া। অর্থাৎ বিমান এবং হেলিকপ্টার দিয়ে পানি দেয়া। তুরস্কের নিজস্ব ৩-৪টি বিমান আছে এই আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট না। পরে আরেও অনেকগুলো প্রশিক্ষণ বিমান ব্যবহার করা হয় এই কাজে। এছাড়াও রাশিয়া, ইউক্রেন এবং আজারবাইজান থেকে আগুন নিভানোর বিমান আনা হয়েছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে তুরস্কের ৪০-৫০টি হেলিকপ্টার, ১০টির মত ড্রোন, কয়েক হাজার ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এবং প্রায় দোষ পনেরো হাজার দমকল বাহিনীর কর্মী।

দেশটির ৪-৫ টা মন্ত্রণালয় একত্রে কাজ করছে এই আগুন নেভানোর জন্য। সাধারণ জনগণ যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে। তাদের মধ্যে একজন এই শাহিক আকদেমির। ২৫ বছর বয়সী এই লোকটি মারমারিসে ট্যুরিজম সেক্টরে কাজ করতো। দাবানলের খবর পেয়ে ছুটে যান সে জঙ্গলের কাছে। দমকল বাহিনীকে জানান তিনি সেচ্ছাসেবী হিসেবে তাদের কাজে সাহায্য করতে চান। কিন্তু দমকল বাহিনী এই কাজে আনাড়ি কাউকে নিতে চায় না। শাহিন কিন্তু নারাজ। চোখের সামনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে মাইলের পড় মাইল। অথচ কিছুই করতে পারছেন না। জোরাজুরি করেন দমকল বাহিনীকে। পরে দমকল বাহিনীর কর্মীরা তাকে শহর থেকে তাদের জন্যও খাবার পানি আনতে বলেন। 

শাহিন খুশি হয় এটাও বা কম কি? নিজে আগুন নেভানোর কাজে সরাসরি যুক্ত হতে না পারলেও যারা কাজ করছে তাদের তো সহযোগিতা করার একটা সুযোগ পেলেন। নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলেন পানি আনতে। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছাড়লেন। বললেন আল্লাহ আমাদের এই সাহায্যকে কবুল করুক। এভাবে কয়েকবার পানি পৌঁছানোর এক পর্যায়ে তার চলাচলের রাস্তাও ছেয়ে যায় আগুনে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেল পিছলে পরে জান আগুনের মধ্যে। আর প্রাণ হারান তিনি। আল্লাহ হয়তো এভাবেই তার সাহায্য এবং প্রচেষ্টা কবুল করেছেন।

এরকম অনেক বীর থাকে আনাচে কানাচে সব দেশেই। আমরা হিরোদের খুঁজি টিভির পর্দায় কিন্তু হিরোরা হয়তো আমাদের পাশেই আছে। ক্রান্তিকালে তারাই হয়তো জীবন দিয়ে রক্ষা করে একটা গ্রাম, মহল্লা, দেশ এবং একটা জাতি। অনেকটা আবেগি হয়ে গেলাম। মনে পড়লো বাংলাদেশের কথা। কিছু মনে করবেন না সরি। এখনও পর্যন্ত এই আগুনে মারা গেছেন চার জন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে। বাড়ি ঘর দোকানপাট ফসলি জমি সবকিছু হারিয়ে পথের ভিখারি হয়েছেন অনেকে। তাদের আহাজারিও দেখেছি আমরা গণমাধ্যমে। অনেকে সরকারকে দোষারোপ করছেন অনেকে নিয়তিকে। অনেকে আবার কিংকর্তব্যবিমুঢ়।

সরকার চেষ্টা করছে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ২১টি প্রদেশের ১১০টি এলাকার প্রায় ১ হাজার ৫০০ পয়েন্টে একই সময়ে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হয় বৈ কি। এই সবগুলো জায়গায় একত্রে দমকলবাহিনী, বিমান এবং হেলিকপ্টার পাঠানো। সেগুলো একই জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা। লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া। তাদেরকে অস্থায়ী থাকার জায়গা এবং খাবারের ব্যবস্থা করা। আক্রান্ত এলাকার বিদ্যুৎ পানি গ্যাস লাইনের নিয়ন্ত্রণ। 

জনগণকে আগুন থেকে দূরে রাখা সবকিছু, মিলিয়ে একটা পুরো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে ওই এলাকায়। কিন্তু আগুন বন্ধ হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক কাঁদা ছোড়াছুড়ি। বিরোধীরা সরকারকে দোষারোপ করছে। আগুন নেভানোর জন্য দমকল বাহিনীকে যথেষ্ট শক্তিশালী ভাবে গড়ে না তোলার জন্য সরকারকে দোষ দিচ্ছে তারা। সরকারের এক্ষেত্রে অবহেলার দোষ দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থার দোষ দিচ্ছে।

সরকার এখন এ নিয়ে রাজনীতি করতে নারাজ। তবে তাদের সন্দেহের তীর এখন কুর্দি সন্ত্রাসী সংগঠন পিকেকে এর দিকে। এই পিকেকের রাজনৈতিক অংশটির নাম HDP। এই কুর্দি HDP দলটি আবার সরকার বিরোধী জোটের একটা অংশ। সুতরাং সন্দেহের তীর কোত্থেকে কোথায় গেলও বুঝলেন তো? তবে অনেকেরই এখন বিশ্বাস যে এতোগুলো জায়গায় একত্রে একই সময়ে আগুন লাগার ঘটনা কাকতালীয় হতে পারে না। বিশেষ করে এই পর্যটন মৌসুমে পর্যটন এলাকাগুলোতে এভাবে আগুন লাগার পিছনে কোন বড় হাত থাকতে পারে।

হতে পারে যে পিকেকে সন্ত্রাসী গ্রুপটি সরকারকে চাপে ফেলতে এই কাজটি করেছে। কারণ এই সন্ত্রাসী সংগঠনটির এর আগেও অনেকবার জঙ্গলে আগুন লাগানর রেকর্ড আছে এবং তারা আগুন লাগিয়ে আবার নিজেরাই সেগুলো ঘোষণা করে জানিয়ে দিয়েছে। তাই ধারণা করা হয়, এই পিকেকে সন্ত্রাসী গ্রুপটি এই কাজটি করে থাকতে পারে। কারণ তারা সিরিয়া এবং ইরাকে বিশেষ করে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে তুরস্কের সামরিক অভিযানে এখন অনেকটাই কোণঠাসা। সেক্ষেত্রে তাদেরকে ইন্ধন দিতে পারে গ্রীস এবং ইসরাইল।

এগুলো আসলেই সব এখন ধারণা। তাই এরকম ধারণার ওপর দিয়ে বলতে গেলে আরও অনেক দূরে টেনে নেয়া যায় এই আলোচনা। যেহেতু সরকার তদন্ত করছে তাই সেই তদন্তের ফলাফল আমরা দেখব। আর আশা করব এই আগুন যেন স্বাভাবিকভাবে লাগা কোন আগুন হয়। এর পেছনে যেন কারো হাত বা ইন্ধন না থাকে। কারণ এগুলো যদি নাশকতা হয়। আর সেই নাশকতা যদি কোনো একটা গ্রুপ করে থাকে, তাহলে তুরস্কের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ। তাহলে ধরে নিতে হবে এটা কোন অশনি সংকেত। কারণ এতো বিশাল একটা নাশকতা যে গ্রুপটি করতে পারে; না জানি ভবিষ্যতে তারা আরও বড় কী করতে পারে।

তবে এখানে তুরস্কের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বন মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে দোষারোপ করতেই হবে। দেশের মধ্যের নিরাপত্তায় নিয়জিত এই সংস্থাগুলো এতো বড় একটা নাশকতা আগে থেকে কেন আঁচ করতে পারলো না। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা। যেই তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থাকে মনে করা হয়, বিশ্বের শক্তিশালী একটা সংস্থা তারা কেন আঁচ করতে পারলো না? নাকি এই গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও রাষ্ট্র বিরোধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে!

আমরা আশা করবো, এই ঘটনার রাজনীতি করন না করে সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে। যেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না হয়। এই দাবানলের ঘটনায় তুরস্কের পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের বহু দেশ কেউ সরাসরি সহযোগিতা করেছে কেউ সংহতি প্রকাশ করেছে কেউ সাহায্য পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে আছে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বহু দেশ। 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে