আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গত বছরের আগস্টে যখন মিশরীয় স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বহুল প্রত্যাশিত সুয়েজ খালের বর্ধিতাংশ উন্মুক্ত করেন- সেই সপ্তাহের জুম্মার নামাযের পূর্বে দেয়া খুতবায় দেশটির সরকারি মসজিদের ইমাম এটিকে ‘স্রষ্টার দেয়া উপহার’ বলে উল্লেখ করেন।
মিশরে গত ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একজন আলেম জনগনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যারা দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর তাদেরকে সম্মান করতে হবে’ এবং একইসাথে সিসিকে ‘পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া’ বলে আখ্যায়িত করেন।
গত অক্টোবরে মিশরের শার্ম আল শেখ অবকাশ কেন্দ্র থেকে ২২৪ জন আরোহী নিয়ে সিনাই উপত্যকায় রাশিয়ান বিমান ধ্বংস হলে দেশটির পর্যটন খাতে বিপর্যয় দেখা দেয়।
এসময় দেশটির ধর্মমন্ত্রণালয় আলেমদেরকে নির্দেশ দেয় মানুষকে অবকাশ যাপন কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে যেন উৎসাহিত করা হয়। যদিও ইসলামে অবকাশ যাপন কেন্দ্রের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।
২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটিতে সামরিক শাসন জারি করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল সিসি। কিন্তু জঙ্গি আক্রমণ ও নড়বড়ে অর্থনীতি নিয়ে সংকটাপন্ন সিসি ক্রমেই ধর্মকে ব্যবহার করে তার ক্ষমতার ভিত মজবুত করার চেষ্টা করছেন। তিনি ধর্মকে ব্যবহার করে তার কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করছেন এবং মুসলিম ব্রাদারহুডসহ বিরোধীদের উপর চালানো দমন-পীড়নকে ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করছেন।
সম্প্রতি জারিকৃত এক ডিক্রিতে সরকার জানিয়েছে, হোসনি মোবারকের পতন দিবস ২৫ জানুয়ারিতে বিক্ষোভ বা প্রতিবাদের ডাক দিলে এবং সেই বিক্ষোভে ‘হত্যা, ভাংচুর ও বিশৃঙ্খলা’ হলে এটাকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে।
ধর্মকে আশ্রয় করে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে মোটেও নতুন নয়। আরব নেতারা কয়েক দশক ধরেই তাদের স্বৈরশাসনকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বৈধ প্রমাণের চেষ্টা করছেন।
সাবেক সেনাপ্রধান সিসিও নিজেকে ধর্মসংস্কারক ঘোষণা করে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ‘ধর্ম বিপ্লবে’র আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের প্রসারের পরিবর্তে তিনি অনিবন্ধনকৃত মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট সিসির এসব কার্যক্রম মিশরের জনগণ কিভাবে দেখছেন তা একটি ঘটনা থেকেই অনুমান করা সম্ভব। সম্প্রতি সিসিপন্থী একজন টিভি উপস্থাপক, যিনি সিসির ডাকে সাড়া দেয়ার কথা টিভিতে বলেছিলেন, মিশরের ১০০০ বছরের পুরনো বিশ্বখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হন। এতেই বুঝতে বাকি থাকে না, সিসির গালভরা ধর্মীয় বক্তৃতা জনগণ মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না।
ইসলাম বেহেরি, ৩৭ বছর বয়সী আইন পাস করা মিশরের এই জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক ‘গোড়া ইসলামের’ তুখোঁড় সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তিনি ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এক টিভি অনুষ্ঠানে আহবান করেন, ‘নবী মুহাম্মদের(স.) যেসব কথাগুলো নিয়ে জিহাদিরা বিশৃংখলা সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেয় সেসব কথাগুলো মুসলিমরা যেন আরো গভীরভাবে ভেবে দেখে। সেসব বইগুলো আমাদের নিষিদ্ধ ও ধ্বংস করে ফেলা উচিত।’
কিছু পশ্চিমা পর্যবেক্ষণকারী মনে করেন, বেহেরি গত জানুয়ারিতে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া সিসির এক বক্তব্যকে খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছেন। সেই বক্তৃতায় সিসি ধর্মীয় পণ্ডিতদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, ‘চরমপন্থীরা বিশৃংখলা সৃষ্টির কারণে এই ধর্মটি আজ পৃথিবীর শত্রুতে পরিণত হয়েছে এবং তা থেকে ইসলামকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।’
তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘এই ভাবনাটা একটি ধারণাতীত ব্যাপার যে, আমরা মুসলিম বিশ্বে শত শত মানুষ শহীদ হয়েছি কিন্তু আসলে তা পুরো বিশ্বের জন্য ক্ষোভ, বিপদ, হত্যা এবং ধ্বংস ডেকে নিয়ে এসেছে।’
কিন্তু আল আজহারের বিশেষজ্ঞরা বেহেরির এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন এবং তারা বলেছেন, বেহেরি ইসলামের মৌলিকতা ভঙ্গ করেছেন। কিছু লোক বেহেরির এ বক্তব্যের জন্য আদালতে একটি ফৌজদারি মামলা করেন। এর ফলে ২৮ ডিসেম্বর বেহেরিকে আদালত ১ বছরের সাজা দেন।
জেলে যাওয়ার আগে বেহেরি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘মিশর একটি অবিচারের দেশ।’
বিচার বিভাগ সিসির বলা ‘ইসলামের আধুনিকরণ’ কথাটির সীমা সংকেত নির্দেশ করেন।
সরকারি অর্থে পরিচালিত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ৬০ বছর ধরে মিশর সরকারের সাথে থাকলেও বিভিন্ন ইসলাম বিষয়ক ব্যাপারে সমালোচনা করে আসছে।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভাগের প্রফেসর নাথান ব্রাউন বলেন, ‘কিছু ধর্মীয় নেতা সিসির বক্তব্যকে ইসলাম ও আল আজহারের সততার প্রতি আক্রমণ বলে মনে করেছেন।’
‘আল আজহারের ছাত্র শিক্ষকেরা সিসির ইসলাম সম্পর্কে দেওয়া বক্তব্যকে নজিরবিহীন ও তিক্ত ঘটনা বলে মনে করছেন। প্রথমে সেখান থেকে সিসির পিছুটান তারপর আবার বেহেরির এই মন্তব্য।’
এখন পর্যন্ত মিশর সরকারে বিভিন্ন হাতের মধ্যে যে সম্পর্ক তা বোঝা অত্যন্ত কঠিন। কিছু বিশেষজ্ঞ মামলার বিষয়টিকে আল আজহারের প্রাতিষ্ঠানিক পেশী শক্তি ব্যবহারের উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে আল আজহার সবসময় সিসিকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
ক্ষমতা দখলের পরে আল আজহারের প্রধান ইমাম শেখ আহমেদ আল-তায়েব সিসির ডাকা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সিসিকে সমর্থন দিয়ে তার পাশেই বসেছিলেন!
তার সপ্তাহ খানেক পরেই আল আজহারের জেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা শেখ আলী গোমা মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের ওপর চালানো নির্যাতনকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘তারা হচ্ছে নিন্দিত চরিত্র’ ও ‘অপবিত্র মানুষ’।
সেনাবাহিনী ও পুলিশকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘ফেরেস্তারা স্বর্গ থেকে তোমাদের সমর্থন দিচ্ছেন।’
একই সময়ে আল আজহারে আস্তে আস্তে একটি কক্ষও সংরক্ষণ করা হয় যেমনটা রাখা হয়েছে বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেও। এর উদ্দেশ্য হলো ইসলামিক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে ইসলাম বিরোধী রণকৌশল করা।
কায়রোর আমেরিকান বিশবিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লেকচারার আশরাফ আল-শরিফ প্রেসিডেন্ট সিসির বিষয়ে বলেন, ‘আমি তাকে একজন স্বৈরশাসক মনে করি না, সে একটি জোটবদ্ধ স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মাত্র।’
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থাকায় আর তারা সিসিকে সমর্থন করায় অনেক মিশরীয়র চোখে সিসি হয়তো কিছুটা বৈধতা পেতে পারেন।
কিন্তু এমন লক্ষণও স্পষ্ট যে সিসির এই পদক্ষেপ তরুণ মিশরীয়দের ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে, যারা দেখেছেন ২০১১ সালের বিপ্লবের পর কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্র ধর্মকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
গতমাসে গ্রান্ড ইমাম শেখ তায়েব কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দূর্লভ সফর করেন। এর বেশ কিছুদিন আগে ‘চরমপন্থার আস্তানা ভাঙ্গার’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ একটি বড় মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে ও কয়েকটি ছোট মসজিদ বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একটি কেন্দ্রীয় মসজিদে এসে নামাজ পড়তে হয়।
সেখানে তাকে কিছু উৎসুক ছাত্ররা এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ইমামের উত্তর বহু ছাত্রকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
লাঞ্চের বিরতির সময় আমিরা আবদেল সাইদ নামের এক ছাত্রী বলেন, ‘ এটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আরেকটি মাধ্যম মাত্র। ইতিমধ্যে এখানে কোনো গণতন্ত্র নেই, এখন তারা বলছে আমরা কোথায় নামাজ পড়ব!’
সরকার যুবকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। যার পরিণতি হচ্ছে সরকারের মুখে তিরস্কার।
ক্যাম্পাসে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। অনেকেই সরকারি গুপ্তচরের ভয় করছে। কেউ প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ।
তবে আদম মুস্তফা নামের এক আইনের ছাত্র বলেন, ‘ধর্ম নিয়ে আলোচনা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। গণমাধ্যমগুলোই এ বিষয়টিকে একটি ইস্যু হিসেবে জিইয়ে রেখেছে, ছাত্ররা নয়।’
অনেক ছাত্র-ছাত্রীই এখন আর আল আজহার কর্তৃপক্ষকে তোয়াক্কা করে না। আমিরা মোহাম্মেদ নামের এক হিজাব পরিহিত ছাত্রী বলেন, ‘শায়খ তায়েব একজন পরিপূর্ণ শায়খ বা ধর্মীয় পণ্ডিত নন। ফতোয়া প্রেসিডেন্ট সিসির পক্ষ থেকে আসে। এটা সবাই জানে।’
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে চরমপন্থার মোকাবেলা করতে হলে কঠোরতার বিকল্প নেই। সিনাই এলাকায় সামরিক বাহিনী ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় এক শাখার সাথে লড়াই করছে। যাদের বিরুদ্ধে অক্টোবরে রাশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান ভুপাতিত করার অভিযোগ রয়েছে।
আদর্শগত কারণে সরকার চরমপন্থীদের কোনো প্রকাশনা স্থানীয় ভাষা ও চীনা এবং উর্দূ ভাষায় প্রকাশ হচ্ছে কিনা এবং এর পক্ষে ধর্মীয় নেতাদের বিভিন্ন ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করছে।
সরকারি সমর্থনপূষ্ট ধর্ম সম্পর্কিত নির্দেশ ও ফতোয়া প্রচারকারি প্রতিষ্ঠানের সদস্য ড. ইব্রাহিম নিজাম বলেন, ‘ইসলামিক স্টেট বা আইএস ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রুপ গুলো যে রোগ ছড়াচ্ছে তার চিকিৎসা আমাদের কাছে আছে।’
স্কুল শিক্ষক আলি কান্দিল, যিনি সরকারকে ‘অত্যাচারী’ বলায় চাকুরিচ্যুত হন, বলেন, ‘ইসলামের নিয়ন্ত্রণের অনুমতি এখন ক্রমেই রাজনৈতিক দল দমনের কাজে ব্যবহৃত হয়। যদি এ নিয়ে কেউ কথা বলে তাহলে হয় সে খুন হবে নয়তো গ্রেপ্তার। যদি সে গ্রেপ্তার না হয় তবে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। যদি সে পালায় তবে তাকে বিশ্বাসঘাতক উপাধী দেওয়া হবে।’
বিশ্লেষকদের মতে মিশরে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। মুসলিম ব্রাদারহুডও সরকারী নীতির বিরুদ্ধে তার সহিংস মনোভাব বজায় রাখছে।
সম্প্রতি শুক্রবারের জুমার খুতবায় দেওয়া সরকারি নির্দেশনার কারণে ২৫ জানুয়ারি সম্ভাব্য বিশৃংখলা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে, যা সিসির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ।
৩১০০ শব্দের ঐ সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে, ‘যেকোন ধরনের নাশকতা এবং বিশৃংখলা যা অন্যান্য আরব দেশগুলোতে করার অনুমতি নেই এমন ধ্বংসাত্মক কোনো জনবিক্ষোভ মিশরেও নিষিদ্ধ।’
শেষে বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ শয়তানকে এড়িয়ে স্রষ্টাকে খুশি করতে চায়, তাহলে সে যেন শাসকের আনুগত্য করে!’
১৩ জানুয়ারি ২০১৬ এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ