জন অ্যালেন : ষাটের দশকে রক ব্যান্ড সিএসএন নবগঠিত মরক্কোর মারাকেশ নগরী নিয়ে গান করেছিল ‘মারাকেশ এক্সপ্রেস’ শিরোনামে। চলতি সপ্তাহে উদারপন্থী একদল মুসলমান নেতা অন্যান্য ধর্মের নেতাদের সঙ্গে রেখে নতুন এক ‘মারাকেশ এক্সপ্রেস’-এর যাত্রা শুরু করাতে চাইছেন।
২৫ থেকে ২৭ জানুয়ারি মরক্কোর মারাকেশ শহরে সমবেত হচ্ছেন প্রায় ৩০০ ইসলামিক শিক্ষাবিদ, আইনবিশেষজ্ঞ, মুফতি ও সরকারি আমলা। তারা পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, নাইজেরিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক ও মিসরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আয়োজক দেশ মরক্কো তো আছেই।
সম্মেলনের লক্ষ্য মদিনা সনদের ভিত্তিতে একটি ঘোষণাপত্র প্রণয়ন। এতে বলা হবে—সব ধর্মীয় সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি প্রচলিত ইসলামিক আইনেই রয়েছে। আয়োজকরা দাবি করছেন, ইসলামী আইন ও সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষা বিষয়ে ইসলামের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এমন সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। মদিনা সনদ অনেকের কাছেই বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে গণ্য।
সম্মেলন আয়োজনে মরক্কো সরকারের সঙ্গে আছে ফোরাম ফর প্রটেকটিং পিস ইন মুসলিম সোসাইটিস। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সংগঠনটির নেতৃত্বে আছেন মৌরিতানিয়ার বিশিষ্ট ইসলামী শিক্ষাবিদ শেখ আবদুল্লাহ বিন বায়াহ। সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজকরা গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার জায়তুনা কলেজের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও বায়াহর ছাত্র হামজা ইউসুফ বলেছেন, শেখ আবদুল্লাহ বিন বায়াহ সুন্নি বিশ্বে সাংবিধানিক আইনের একজন শীর্ষ নেতা। মৌরিতানিয়ার সংবিধান প্রণেতাদেরও একজন তিনি। হামজা ইউসুফ বলেন, মুসলিম বিশ্বে আজ যা হচ্ছে, বিশেষ করে ইরাকে ইয়াজেদি, ইয়েমেনে ইহুদি এবং সিরিয়া ও মিসরে খ্রিস্টান সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনায় শেখ আবদুল্লাহ খুবই মর্মাহত।
অবশ্য উদার মুসলিম নেতারা প্রায়ই এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকেন এবং পশ্চিমা সমাজে বার্তাটি ভালোই কদর পায়। তবে বিশ্বের মুসলিম সমাজের জন্য তাঁদের উদ্যোগ খুব কমই তাত্পর্য বহন করে। এর অন্যতম কারণ এই যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর রাজপথে এই উদ্যোক্তাদের প্রভাব কমই আছে।
মারাকেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি ও ইরানের একাডেমি অব সায়েন্সের প্রধান। কিন্তু পাকিস্তান বা ইরান কারোরই সমাজকে আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ বলে দাবি করতে পারি না।
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইন দিয়ে প্রায়ই অমুসলিমদের নিপীড়ন করা হয়। একটি উদাহরণ হতে পারে আছিয়া বিবি। ক্যাথলিক খ্রিস্টান আছিয়ার পড়ালেখা নেই। খামারে কাজ করতেন। পাঁচ সন্তানের মা। আজ তাঁর সামনে ঝুলছে মৃত্যুদণ্ডের রায়।
আশার খবর হচ্ছে—মুসলিম সমাজে কোণঠাসা অবস্থায় থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক নেতাও মারাকেশ সম্মেলনে অংশ নিয়ে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ইরাক সরকারের মন্ত্রী খালিদ আমিন রুমি ও ফিলিস্তিনের খ্রিস্টান নেতা বিশপ মুনিব ইউনান।
জঙ্গিবাদের কারণে বিশ্বজুড়ে এক ধরনের ইসলাম-আতঙ্ক কাজ করছে। এ কঠিন সময়ে মুসলমান শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সম্মেলনে অন্যান্য ধর্মের নেতাদেরও সমবেত হওয়ার বিষয়টির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন নর্দান ভার্জিনিয়ার অ্যাডামস সেন্টারের ইমাম মোহাম্মদ মজিদ। তিনি বলেন, ইসলামফোবিয়ার এই সময়ে আমরা যদি পোপের সঙ্গেও বৈঠক করতে পারতাম এবং সম্মেলনের ঘোষণাপত্রটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ পেতাম খুব ভালো হতো।
তবে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এই সম্মেলন নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাই। প্রথমত. উদারপন্থী অনেক মুসলিম নেতা এর আগেও এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন, যা দৃশ্যমান কোনো ফল দেয়নি। যেমন—২০০৬ সালে পোপ সহিংসতার সঙ্গে ইসলাম ধর্মকে জড়িয়ে বিতর্কিত এক বক্তব্য দেওয়ার পর জর্দানের প্রিন্স গাজী বিন মুহাম্মদ ‘কমন ওয়ার্ল্ড’ উদ্যোগ নেন। গণমাধ্যমে ফলাও করে বিষয়টি আসে এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিনিধি তাতে অংশ নেন। কিন্তু ইসলামিক স্টেট—আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান তো ঠেকানো গেল না। ইসলামিক চরমপন্থাও পেল নতুন মাত্রা। মারাকেশ সম্মেলন এ-জাতীয় সহিংসতা থেকে আমাদের মুক্ত করবে এ আশা করি কী করে!
দ্বিতীয়ত. মুসলিম বিশ্বে মরক্কো তেমন কোনো শক্তিধর নয়। মিসর, সৌদি আরব কিংবা ইরানের মতো প্রভাবশালী দেশের নেতৃত্ব আয়োজনটি হলে সম্ভবত বেশি কার্যকর হতো।
তৃতীয়ত. মদিনা সনদের পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আমূল পরিবর্তন ঘটেছে সমাজব্যবস্থার। একুশ শতকে এসে এই সনদের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অবকাশ কতখানি আছে এ সংশয় তো থাকেই।
যা হোক, প্যারিসে জঙ্গি হামলায় রক্তের ধারা বয়ে যাক কিংবা সিরিয়ায় গণহত্যা হোক, প্রতিবারই পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সমস্বরে দাবি করা হবে যে উদারপন্থী মুসলমান—যারা বলে থাকে ইসলাম শান্তির ধর্ম, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। এমন অনেক মুসলিম নেতাই এই সপ্তাহে মারাকেশ সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন। বার্তাটি ছড়িয়ে যাক। উত্সাহ ও সমর্থন পাক—এ ধরনের সব আশাজাগানিয়া উদ্যোগ।
লেখক : বোস্টন গ্লোবের সহযোগী সম্পাদক
সূত্র : ক্রাক্সনাও এবং কালেরকণ্ঠ
২৫ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি