সোমবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ০৭:০৭:৫৬

মেয়েকে খুন করে বাবা বললেন ‘‘লজ্জা ধুয়ে ফেললাম!’’

মেয়েকে খুন করে বাবা বললেন ‘‘লজ্জা ধুয়ে ফেললাম!’’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নিজ হাতে মেয়েকে খুন করলেন বাবা! প্রথমে শ্বাসরোধ, তারপর গুলি। নিজের বাড়িতেই নির্মমভাবে খুন হন এক তরুণী ইউটিউবার। নিহত ইউটিউবারের নাম টিবা আলি খান। বয়স ২২ বছর। নিজের দৈনন্দিন জীবনের নানা মুহূর্ত তিনি ইউটিউবে ভিডিও পোস্ট করে জানাতেন টিবা। ইদানীং ভক্তসংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছিল তাঁর।

ঝলমলে উচ্ছল মেজাজের মেয়ে টিবা। হাত নেড়েচেড়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের ভাল থাকার কথা বলেন। হাজার হাজার অনুরাগী, অনুগামীকেও নিত্য ভাল থাকার রসদ জোগান, সেই মেয়ে না কি তাঁর পরিবারের ‘লজ্জার কারণ’ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন! সম্প্রতি সেই মেয়েকেই নিজে হাতে খুন করলেন তাঁর বাবা! ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই হইচই পড়ে গেছে ওই ইউটিউবারের ভক্তদের মধ্যে। টিবার নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়ে।

ইরাকের মেয়ে টিবা। রক্ষণশীল সমাজে বড় হয়েছেন। পরিবারও রক্ষণশীল। সেই পরিবার থেকে বেরিয়ে ইউটিউবার তারকা হওয়ার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছিল তাঁকে। নিজের বাড়িতে তো বটেই, নিজের দেশও ছেড়েছিলেন টিবা। থাকতেন তুরস্কে। সঙ্গে থাকতেন তাঁর প্রেমিকও। তিনি সিরীয় বংশোদ্ভূত। ইউটিউবেই নিজেদের বাগদানের কথা ঘোষণা করেছিলেন টিবা।

সম্প্রতি তুরস্ক থেকে ইরাকে নিজের বাড়ি ফিরেছিলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এসেছিলেন বাবা-মায়ের কাছে। তবে টিবা বাড়িতে আসার পর থেকেই তাঁকে নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। অশান্তি মেটাতে পুলিশকেও আসতে হয়েছিল বাড়িতে। ইরাকের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী সাদ মানও সে কথা জানিয়েছেন। 

একটি বিবৃতি দিয়ে সাদ বলেছেন, ‘‘টিবা আলি এবং তাঁর আত্মীয়দের সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ।’’ কিন্তু সেই সমাধানসূত্র যে কোনো কাজেই দেয়নি তা স্পষ্ট হয়ে যায় গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে টিবার রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হওয়ার পর। 

পুলিশ জানিয়েছে, গত ৩১ জানুয়ারি রাতে মেয়েকে ঘুমের মধ্যেই শ্বাসরোধ করে খুন করেন তাঁর বাবা। তারপর গুলিও করেন। তবে খুন করার পর তা গোপন করেননি টিবার বাবা। 

পুলিশ জানিয়েছে, টিবার বাবা নিজেই এসে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, খুন তিনিই করেছেন। কেন খুন করেছেন, তার কারণও জানান। ইউটিউবার টিবার বাবা প্রকাশ্যেই খুনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘লজ্জা ধুয়ে ফেললাম।’’ 

টিবার মৃত্যুর খবর পেয়ে চমকে যান দুইদিন আগে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আসা পুলিশকর্তারাও। ইরাকের এক সংবাদ সংস্থাকে তাঁরা বলেন, ‘‘আমরা শুনে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। এমনটা যে হতে পারে ভাবতেই পারিনি। জানলে হয়তো অন্য পদক্ষেপ করতাম।’’ এরপরেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে আগুনের গতিতে। 

দেশের ইউটিউব প্রভাবশালী টিবার মৃত্যুর খবর এবং মৃত্যুর ধরনে চমকে যান ইরাকের মানুষ। মেয়েরা প্রতিবাদে প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নামেন। বিক্ষোভের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। টিবার মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে আসতে থাকে নানা তথ্য। ইরাকের মানবাধিকার কর্মী হানা এদোয়ার একটি ভয়েস রেকর্ডিং দিয়ে জানান, টিবাকে শুধু ইউটিউবার হওয়ার জন্যই দেশ ছাড়তে হয়নি।  

হানা জানিয়েছেন, যে ভয়েস রেকর্ডিংটি তাঁর হাতে এসেছে, তাতে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে টিবা, তাঁর মা এবং বাবার কথোপকথন। যেখানে বার বার টিবা তাঁর বাবা-মাকে ‘তোমার ছেলে’ বলে ক্ষোভ দেখাচ্ছেন। চিৎকার করছেন। একই সঙ্গে তাঁকে বলত শোনা যায়, ‘‘তোমাদের ছেলের সঙ্গে এক ছাদের তলায় আমি থাকব না।’’ যদিও হানার দেওয়া ওই ভিডিও রেকর্ডিং সত্যিই টিবা এবং তাঁর বাবা-মায়ের কথোপকথন কি না, তা যাচাই করা যায়নি।

২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে তুরস্কে বেড়াতে গিয়েছিলেন টিবা। শোনা যায়, তারপর আর সেখান থেকে ফিরে আসতে চাননি তিনি। তাঁর এই সিদ্ধান্তে অত্যন্ত ক্রু'দ্ধ হয়েছিল পরিবার। কিন্তু টিবা জেদ ছাড়েননি। তারপর থেকে তুরস্কেই স্বাধীনভাবে থাকতে শুরু করেছিলেন টিবা। তবে পরিবার কখনই তা মেনে নেয়নি। 

টিবা অবশ্য সেই আপত্তিকে গুরুত্বও দেননি। টিবা ইউটিউব ভিডিওতে তাঁর নিত্যদিনের জীবনযাপনের যে সমস্ত ভিডিও পোস্ট করতেন, তাতে রক্ষণশীলতা ছিল না একেবারেই। প্রতি মুহূর্তে নিজের দেশের রক্ষণশীল মনোভাবকে ভেঙে বেরোচ্ছিলেন টিবা। টিবার ভিডিওতে যেমন তাঁর খোলামেলা পোশাকের ছবি থাকত, তেমনই প্রেমিকের সঙ্গে বিভিন্ন মুহূর্তের দৃশ্যও থাকত। 

সেই সব মুহূর্তের বেশ কিছু তাঁদের একান্ত যাপনেরও। টিবার সঙ্গে তাঁর প্রেমিকের ওই রসায়ন পছন্দ করতেন ইউটিউবে তাঁর অনুরাগীরা। গত বেশ কয়েক মাসে টিবার অনুগামী সংখ্যা অনেক বেশি হারে বাড়ছিল ইউটিউবে। টিবাও নিয়ম করে পোস্ট করতেন তাঁর ভিডিও। 

এদিকে টিবার মৃত্যুতে ইরাকের মেয়েরা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘‘আমাদের সমাজে নারীরা আসলে কিছু পুরুষের অহংআর পিছিয়ে পড়া রীতির খাঁচায় ব'ন্দি। মেয়েদের বাঁচানোর জন্য যথাযথ আইন এবং সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে। তাই এভাবে নিজেদের বাড়িতেই অত্যাচারিত হতে হয় মেয়েদের।’’ 

পোস্টার হাতে এই সমস্ত পুরুষদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের দাবি তুলে ইরাকের মেয়েরা বলেছেন, যত দিন না এঁদের বিরুদ্ধ কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে, ইরাকে এভাবেই খুন হতে হবে মেয়েদের। এই দাবিতে রবিবারও বাগদাদে পথে নেমেছিলেন ইরাকের মেয়েরা। বিশ্বজুড়ে উঠেছে টিবার সুবিচারের দাবি। তবে তাঁদের সেই দাবিরও জবাব আগেই দিয়েছেন টিবার বাবা।

টিবার বাবা তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, তিনি পরিবারের সম্মানরক্ষায় হত্যা করেছেন মেয়েকে। ইউটিউবারকে হত্যার অপরাধে যদি বা তিনি শাস্তি পান, তবে সেই শাস্তিও কম হবে। কারণ ইরাকে সম্মানরক্ষায় কোনো অপরাধ করলে অপরাধীকে কম সাজা দেওয়া হয়! আইনের ধারা জেনে নিয়েই নিজের মেয়েকে হত্যা করেছেন টিবার বাবা। সূত্র : আনন্দবাজার

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে