সামন হোসেন, গৌহাটি (আসাম) থেকে : গৌহাটি শহরে গেমস নিয়ে খুব বেশি আলাপ-আলোচনা নেই। বরং গেমসের নামে আসামে তথা গৌহাটিতে রাজনীতির প্রবল উত্তাপ প্রবাহ বিরাজমান। দক্ষিণ এশিয়ান গেমস ঘিরে সারা শহরেই দুই নেতার ব্যানার ফেস্টুনের রমরমা মহড়া।
কে কাকে ছাড়িয়ে যাবেন; টক্কর সেখানে। একজন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রীড়ামন্ত্রী এবং বিজেপির নেতা সর্বানন্দ সানওয়াল। অন্যজন কংগ্রেসের নেতা রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। মাস দুয়েক বাদেই আসামের বিধানসভার নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই দুই নেতা গেমসের শতভাগ সুবিধা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন।
সর্বানন্দ সানওয়াল আবার দক্ষিণ এশিয়ার এই চলতি আসরের সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান। আসাম অলিম্পিক এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হলেন তরুণ গগৈ। অলি-গলি থেকে শুরু সবখানেই তাদের ব্যানার-ফেস্টুনের পসরা সাজানো। চায়ের দোকান; ঝটকেন্দ্রে গেমস নয়, আলোচনা শুধুই নির্বাচন। এ কারণে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমেও গেমসের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনীতি ইস্যু।
১২তম দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের ২৩ ডিসিপ্লিনের ১৭টি ডিসিপ্লিন গৌহাটিতে। বাদবাকি ৬টি শিলংয়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-এর উদ্বোধন করেছেন গৌহাটিতে। মাত্র তিন মাসের প্রস্তুতিতে গৌহাটি পুরোপুরি প্রস্তুত না হলেও গেমস প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। শেষ মুহূর্তেও এখানকার রাজনীতি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপি হলেও আসামের নেতৃত্বে কংগ্রেস। তাদের নেতাই তরুণ গগৈ এখানকার মুখ্যমন্ত্রী। তাকে হটিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসতে চাইছেন বিজিপির সর্বানন্দ সানওয়াল। তিনি আবার ভারতের ক্রীড়ামন্ত্রী, তার ক্ষমতাবলে কেরালার এসএ গেমস চলে এসেছে আসামে।
গেমস আয়োজনের মাধ্যমেই মোদিকে তিনি নিয়ে এসেছেন গৌহাটিতে। মোদির উদ্বোধনী ভাষণও ছিল নানা প্রতিশ্রুতি কেন্দ্রিক। এসবের মাধ্যমেই সানওয়াল টেক্কা দিতে চাইছেন তরুণ গগৈ’কে। ২০১১ সালে আসামের বিধান সভার সর্বশেষ নির্বাচনে ১২৬ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৭৯টি আসনে জয়লাভ করে। অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রোসি ফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক দল জিতে ১৮টি আসনে। ওই নির্বাচনে বিজেপি মাত্র নয়টি আসনে জয়লাভ করে।
যদিও পরবর্তীতে বিজেপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ পুরো ভারতের প্রেক্ষাপট বদলে যায়। পুরো ভারতে বিজেপি রাজত্ব করতে পারলে এখানে কংগ্রেসে ক্ষমতায় হানা দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। নির্বাচনের আগে নানাভাবেই এখানকার লোকদের বাগে আনতে চেষ্টা করছেন সর্বানন্দ সানওয়াল। কিন্তু এখানে তার মূল সমস্যা হচ্ছে বাঙ্গালীরা। আসামের মূল জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ বাঙ্গালী। এই বাঙ্গালীদের নয়নের মনি তরুণ গগৈ।
এ কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরও বাঙ্গালীদের বাগে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে বিজেপি। এমন সময়ে ভোটারদের চাঙ্গা করতে ‘বাংলাদেশ’ নামে তুরুপের তাস চেলেছেন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি অমিত শাহ। এক চালেই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ১৪টি আসনের মধ্যে সাতটিতেই জয় পেয়েছিল তার দল।
স্থানীয় নির্বাচনের জনসভায় তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে আসাম শাসন করছে কংগ্রেস। কিন্তু আসামের কোনো উন্নতিই হচ্ছে না। দেশের চতুর্থ দরিদ্র রাজ্য আসাম। এত অধিক মাত্রায় দুর্নীতি থাকলে কোনো রাজ্য সামনে এগিয়ে যেতে পারে না, বলেন অমিত শাহ। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে অমিত শাহর মতোই মন্তব্য করেছিলেন।
এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘আপনারা লিখে রাখতে পারেন, ২০১৬ সালের মে মাসের পরে এই অবৈধ বাংলাদেশিরা তাদের ব্যাগ প্রস্তুত করবেন ভারত ছাড়ার জন্য।’ বিজেপির এই কথার রাজনীতির জবাবে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ অনেকটা পরিহাস করেই বলেছেন, ‘একমাত্র নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বাংলাদেশিদের কথা মনে পড়ে বিজেপির।’
মুসলমানরাও এখানকার রাজনীতিতে বড় একটা প্রভাব রাখে। আসামের মোট জনসংখ্যার ৬১ শতাংশ হিন্দু, ৩৪ শতাংশ মুসলিম। গত নির্বাচনে মুসলমানদের ভোটেই মওলানা বদরউদ্দিন আজমলের দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রোসি ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। তাদেরও একটা প্রভাব থাকবে আসন্ন নির্বাচনে।
ডেকান হেরাল্ডের বিশেষ প্রতিনিধি রনদিপ চৌধুরীর মতে তিন মাস আগেও এখানে এসএ গেমসের নাম নিশানা ছিল না। কেউ জানতোও না দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞটি এখানে অনুষ্ঠিত হবে। তবে হুট করে অগোছালো ভাবে গেমসটি এখানে আয়োজন করা হয়েছে স্রেফ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। একারণে গেমসের শেষ দিনেও আয়োজকদের ঢিলামি চোখে পড়েছে।
গৌহাটি শহরকেন্দ্র থেকে মিনিট পঁচিশের পথ। শহরতলী বলতে যা বুঝায়; তাও নয়। শহরের উপকণ্ঠে এক সমৃদ্ধ ক্রীড়া কমপ্লেক্স আগেই ছিল। পাশাপাশি অনেকগুলো ভেন্যু। ১২ দিনব্যাপী এই আসরের প্রধান ভেন্যু ইন্দিরা গান্ধী অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়াম। এই আয়োজনের উদ্বোধন হয়েছে ইন্দিরা গান্ধী অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়ামেই।
৮ বছর আগে গড়ে ওঠা এই স্টেডিয়ামটি আলাদাভাবে ফুটবল এবং অ্যাথলেটিক্সের জন্যই করা হয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার দর্শক এখানে চাইলে একসঙ্গে ইভেন্ট উপভোগ করতে পারেন। এই স্টেডিয়ামের খুব কাছেই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসাইন সাঁতার কমপ্লেক্স। আর বাস্কেটবল এবং হ্যান্ডবলের জন্য রয়েছে নবীন চৌধুরী রবদোলাই এসি ইনডোর স্টেডিয়াম।
তবে এখানে প্রাণের উত্তাপ সেই অর্থে দেখা যায়নি। শুধু প্রধান মিডিয়াকেন্দ্র থাকার কারণেই এখানে জড়ো হতে হয়েছে। সমস্যা যা হয়েছে গেমস কাভার করতে আসা দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের। ইন্দিরা গান্ধী অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়ামেই মূল মিডিয়া কেন্দ্রস্থাপনা করা হয়েছে।
আশপাশে এখনও নেই কোনো হোটেল। ফলে যারা আসর কাভার করতে এসেছেন; তাদের ১০-১২ কিলোমিটার দূরে থেকেই মিডিয়াকেন্দ্রে আসতে হচ্ছে। এই মিডিয়া কেন্দ্রেও স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের মুখে আলোচনা আসন্ন নির্বাচন। -এম.জমিন
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস