আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মহাকাশে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করছে চীন। এরই মধ্যে দেশটির এক বিজ্ঞানীর করা সেই বাঁধের একটি নকশাও প্রকাশ করা হয়েছে। চীনের এই উচ্চাভিলাষী এই পরিকল্পনার কথা সামনে আসতেই বিশ্বজুড়ে শোরগোল পড়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মহাকাশে কীভাবে আর কেনইবা তৈরি করা হবে এই বাধ।
চীনা সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব প্রশ্নের জবাব। বলা হয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করতেই উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বেইজিং। এটা করা হবে মূলত মহাকাশে সোলার পাওয়ার স্টেশন তথা সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে। আর এই পরিকল্পনাকে বলা হচ্ছে, ‘পৃথিবীর ওপর বা মহাকাশে আরেক থ্রি গর্জেস বাঁধ’।
চীনের মধ্যাঞ্চলে ইয়াংজি নদীর ওপর থ্রি গর্জেস ড্যাম নামে একটি বাঁধ রয়েছে যেটা বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ। মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে তৈরি করা হয় বাঁধটি। যেখান থেকে বছরে ৮৮.২ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
এই থ্রি গর্জেস ড্যাম নামের সঙ্গে মিলিয়ে মহাকাশের প্রস্তাবিত বাঁধকে বলা হচ্ছে, ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম অন স্পেস ‘ বা ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম অ্যাবাভ আর্থ’ যার অর্থ মহাকাশে থ্রি গর্জেস বাঁধ। আর এটার উদ্দেশ্যও বিদ্যুৎ উৎপাদন। যদিও এর বাস্তবায়ন নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বিশ্বের অনেক মহাকাশ গবেষক।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাশূন্যে এই বাঁধ নির্মাণের নকশা এঁকেছেন চীনের বিখ্যাত রকেট বিজ্ঞানী লং লেহাও। কীভাবে মহাশূন্যে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করবেন বিজ্ঞানীরা, তার রূপরেখাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার ওপরে পৃথিবীর জিয়োস্টেশনারি কক্ষপথে এক কিলোমিটার প্রশস্ত সৌর প্যানেল বসানো হবে। সেই সৌর প্যানেল বসানোর কাজ শেষ হলে সেগুলো দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
চীনা গবেষকদের দাবি, দিন-রাতের চক্র, আবহাওয়া বা ঋতু পরিবর্তনের জেরে এই সৌর প্যানেলের কোনো ক্ষতি হবে না। সেখান থেকে সবসময় বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। রকেট বিজ্ঞানী লং বিদ্যুৎ তৈরির এই নিরবচ্ছিন্ন প্রকল্পকে থ্রি গর্জেস ড্যামের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই সঙ্গে এরই মধ্যে এর কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিজ্ঞানী লং বলেছেন, ‘আমরা এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিয়েছি। ভূপৃষ্ঠের ২২ হাজার ৩৭০ মাইল উপরে জিয়োস্টেশনারি কক্ষপথে থ্রি গর্জেস ড্যামের মতোই সৌর প্যানেল বসানো হবে। সেখান থেকে আমরা যে সৌরশক্তি পাব তা এক বছরে উত্তোলন করা অপরিশোধিত তেলের সমান হবে। এটা একটা অবিশ্বাস্য প্রকল্প। আমরা এখন শুধুই সামনের দিকে তাকিয়ে আছি।’
কীভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে সে ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের বাস্তবায়নে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রকেটের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে এই বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন চীনা মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। পুনর্ব্যবহারযোগ্য ভারি বস্তু বহনে সক্ষম রকেট নির্মাণের চেষ্টা হচ্ছে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন বিজ্ঞানী লং। অবশ্য এই প্রকল্প নিয়ে চীন সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কিছু বলা হয়নি।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বিজ্ঞানী লং জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের জন্য মোট দু’টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রকেটের প্রয়োজন হবে। তার মধ্যে একটি হল ‘সিজেড-৫’। এটি লম্বায় ৫০ মিটার। দ্বিতীয় রকেটটির নাম ‘সিজেড-৯’ রেখেছেন চীনা মহাকাশ গবেষকেরা। মহাশূন্যে সৌর প্যানেল বসানোর কাজ এই দ্বিতীয় রকেটটি করবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানী লং।
লংয়ের কথায়, ‘সিজেড ৯-এর উচ্চতা হবে ১১০ মিটার। এটি ১৫০ টন পর্যন্ত সামগ্রী বহন করতে পারবে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে সৌর প্যানেল পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এটা হবে একটা আদর্শ বাহন।
নাসার ‘স্যাটার্ন-৫’ এবং স্পেস লঞ্চ সিস্টেমে যে সব উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রকেট রয়েছে, সেগুলো ১৩০ টন পর্যন্ত সামগ্রী বহন করতে পারে।’ সেখানে অতিরিক্ত ওজন বহনে চীনা রকেট রেকর্ড তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি।
এই ধরনের প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে আগেও আলোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মূলত পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সৌরশক্তিকেই বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছেন গবেষকেরা।
পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা মহাকাশভিত্তিক সৌরশক্তি কেন্দ্রগুলো এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভূপৃষ্ঠে পাঠিয়েও থাকে। আন্তর্জাতিক স্তরে এর নাম ‘ম্যানহাটন প্রকল্প’। চীন এই ধরনের কাজই মহাশূন্য করতে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্বের গবেষকদের একাংশ। তবে নিঃসন্দেহে তা অনেকটা বড় আকারের হবে বলে স্পষ্ট করেছেন তারা।
গত কয়েক দশক ধরেই সৌরশক্তি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোচনা চলছে। সে ক্ষেত্রে মহাকাশকে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, তা-ই নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন তারা। চীনের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গবেষণার নতুন দিক খুলবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে এই দৌড়ে শামিল হয়েছে চীনও। ইতিমধ্যেই অন্তরীক্ষে নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করেছে দেশটি। এবার সেখানে সৌর প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্রকে তারা অনেকটাই পেছনে ফেলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।