আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বাবার কাছে থাকতে চেয়েছিল নিখোঁজ হওয়া ১০ বছরের নীলাঞ্জনা৷ তার মা-বাবার সংসারে চলছিল ঝামেলা। আর তাই মা তার বাবাকে ছেড়ে চলে যায় নতুন স্বামীর সংসার৷ কিন্তু মা তার মেয়ের উপর দখল ছাড়তে নারাজ৷ 'নিখোঁজ' মেয়েকে উদ্ধারের আশায় পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি৷ সেই পুলিশেরই চরম গাফিলতিতে চিরতরে টানাপোড়ন শেষ হল ওই ছোট্ট মেয়েটির৷ ওই কিশোরীকে বাবার কাছ থেকে উদ্ধার করে বাসার পাঠানোর সময় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল নীলাঞ্জনার এবং এক সিভিল ভলান্টিয়ারের৷ সব থেকে বড় কথা হেফাজতে থাকাকালীন ওই বালিকার মৃত্যু হওয়ায় প্রশ্নের মুখে পুলিশি নিরাপত্তা৷ টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা যায়।
তবে একই সঙ্গে মা-বাবার বিচ্ছেদে মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত ওই বালিকার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে তার স্বজনদের মাঝেও৷ রবিবার গভীর রাতে অটোরিক্সায় করে নীলাঞ্জনাকে সরকারি অফিসে পৌঁছে দিতে সোনারপুর থানা থেকে রওনা দেয় পুলিশের একটি দল৷ রথতলার কাছে হঠাত্ করেই পিছন থেকে ধাক্কা মেরে অটোরিক্সাটিকে পিষে দেয় একটি লরি৷ ওই অটোতে সে সময় নীলাঞ্জনা দেবনাথ ছাড়াও ছিলেন আরো চার পুলিশ সদস্য এবং চালক৷
অর্থাত্ অটোর ভিতরে ছিলেন মোট ছ'জন যাত্রী৷ উপরন্তু ঘটনার সময় অটো চালাচ্ছিলেন পুলিশের এক 'ডোম'৷ এম আর বাঙুর হাসপাতালের সুপার অনুরাধা দেব জানিয়েছেন, কারো রক্তপরীক্ষায় কোনো রকমের আলামন মেলেনি৷ স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, ওই অটোর চালক সুশান্ত হালদার সোনারপুর থানায় ডোমের কাজ করে৷ তিনি 'সুশান' নামেই পরিচিত৷ গড়িয়া-গোল পার্ক অটো রুটের সাধারণ সম্পাদক দেবরাজ ঘোষ জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত অটোটি নেপাল রাউতের৷ তার চারটি অটোই এনেক দিন ধরে রাতে সোনারপুর থানায় ভাড়া খাটে৷ থানার চালকই অটো চালায়৷ এখানেই প্রশ্ন, কেন গভীর রাতে এক বালিকাকে জেলে রাখার জন্য নিজেদের গাড়ি অথবা ভ্যান ব্যবহার করল না পুলিশ? আর অটো নিলেও কেন আইন ভেঙে তাতে ছ'জন উঠলেন? কেন চালককে অটো চালাতে না দিয়ে এক ডোমকেই পুলিশ যোগ্য সারথি হিসেবে বেঁচে নিল? পুলিশের অবশ্য ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত ভাবেই অন্য রকম৷
গাফিলতি মানতে নারাজ দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী৷ তার ব্যাখ্যা , 'ওই সময় সোনারপুরের সব ভ্যান অন্যত্র তল্লাশিতে বেরিয়েছিল৷ সে কারণে অটো ভাড়া করা হয়৷ বাচ্চাটি খুব কান্নাকাটি করায় ওকে ঘিরে রাখতেই এতজন মিলে অটোয় ওঠে৷' আর ডোমের প্রসঙ্গে সুপারের সাফাই, 'ও অটো চালকই ছিল৷ ডোম ছিল না৷' মৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম অপূর্ব নস্কর৷ এই ঘটনায় প্রাণ হারানো বালিকার জীবনকথাও বেশ মর্মান্তিক৷ নীলাঞ্জনার মা বন্দনা দেবনাথ এবং বাবা তুফান গায়েনের মধ্যে কয়েক বছর আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়৷ বিবাহবিচ্ছেদের পর বন্দনা অন্য একজনকে বিয়ে করেন৷ মায়ের সঙ্গেই নতুন ঠিকানায় গিয়ে ওঠে ওই নীলাঞ্জনা, যার আগের নাম ছিল তৃষা৷ কিন্তু নীলাঞ্জনা বারবারই ফিরে যেতে চাইত তুফানের কাছে৷ মায়ের নতুন সঙ্গীর সঙ্গে তেমন একটা বনিবনা হচ্ছিল না বলেই জানা যায় পরিবার পক্ষ থেকে৷ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধের পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় ওই কিশোরী৷ মা অবশেষে সোনারপুর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন৷
রবিবার সাতটার দিকে অপহরণের অভিযোগে সোনারপুর পুলিশের একটি দল পাথরপ্রতিমায় ওই মহিলার সাবেক স্বামী তুফানের বাড়ি পৌঁছয় এবং প্রত্যাশা মতোই তৃষাকে বাবার কাছে পাওয়াও যায়৷ কিন্তু সে যে নিজের ইচ্ছেয় বাবার কাছে এসেছে তা বলায় পুলিশ তুফানকে অবশ্য গ্রেন্তার করেনি৷ কিন্তু বাবাকে ছাড়তে না-চেয়ে পুলিশের সামনেই কান্নাকাটি শুরু করে দেয় সেই কিশোরী৷ অবশেষে বাবা তার সঙ্গে যেতে রাজি হওয়ায় পুলিশ বুঝিয়ে কিশোরীকে রবিবার রাত ১১টার দিকে সোনারপুর থানায় নিয়ে আসে৷ এরপর সুভাষগ্রাম গ্রামীণ হাসপাতালে তার শারীরিক পরীক্ষার পর কিশোরীকে নরেন্দ্রপুরে নিয়মমাফিক একটি সরকারি বাসায় পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করেন পুলিশ কর্মকর্তারা৷ নরেন্দ্রপুর যাওয়ার সময়ই পুলিশের চরম গাফিলতিতে রথতলার কাছে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে।
দুর্ঘটনায় আহতদের রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে গড়িয়ার দিকে যাওয়া এক অ্যাম্বুলেন্স চালকই প্রথম আহতদের স্থানীয় একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে নিয়ে যায়৷ সেখান থেকে পরে এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে নীলাঞ্জনাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়৷ অপূর্বকে অপারেটিং টেবিলে তোলা হলে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন এমআর বাঙুর হাসপাতালের সুপার৷ সোনারপুর থানার এএসআই তীর্থপতি বসু, ভিলেজ পুলিশ প্রসেনজিৎ সাপুই, চালক সুশান্ত হালদার এবং এক মহিলা হাম গার্ড রানু চক্রবর্তীকে চিকিত্সার জন্য হাসপাতালে রাখা হয়েছে৷ শেষ ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে ময়না -তদন্তের পর নীলাঞ্জনার দেহ তার বাবা তুফান গায়েনের হাতে তুলে দেয়া হবে৷
২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই