আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলার জেরে বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের বাসভবনে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। তারপর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি পদক্ষেপ ঘোষণা করে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল থেকে শুরু করে সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত, অটারি সীমান্ত বন্ধের কথা ঘোষণা করা হয়। এক দিনের মাথায় পাকিস্তানও পদক্ষেপ নিল।
চরম উত্তেজনার শুরুতেই ভারতকে পেছনে ফেলল পাকিস্তান! ভারতের পাঁচের বদলে তারা আটটি পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে। সঙ্গে দীর্ঘ বিবৃতিতে ভারতের একাধিক নীতির কড়া সমালোচনা করেছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তানের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত বিরোধ কাশ্মীর। জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাবে তা স্বীকৃত।
কাশ্মীরের মানুষের অধিকারকে পাকিস্তান সমর্থন করে। ভারতের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সেখানকার মানুষ পছন্দ করে না। এতে কাশ্মীরে সহিংসতা স্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে ভারতে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনও বৃদ্ধি পেয়েছে।
জোর করে ওয়াকফ বিল পাস করা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভারতের সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপ।’
পাকিস্তান আরো বলেছে, ‘পেহেলগামের মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে কাজে লাগানোর ইচ্ছা ত্যাগ করতে হবে ভারতকে। তারা নিজেদের জনগণকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি, তার দায় নিতে হবে।’
বিবৃতি অনুযায়ী, ‘পাকিস্তান সর্বপ্রকারে সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে। বরং পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে ভারত পূর্ব সীমান্তে বারবার অশান্তির চেষ্টা করে থাকে।
কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও প্রমাণের অভাবেই পেহেলগামের ঘটনাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এটা ভিত্তিহীন। এটা আসলে হেরে যাওয়ার যুক্তি। এর বিপরীতে, পাকিস্তানে ভারতীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। পাকিস্তানি জেলে বন্দি কুলভূষণ যাদব এর জলজ্যান্ত প্রমাণ।’
এ ছাড়া ভারতের পদক্ষেপগুলোর নিন্দা করেছে পাকিস্তান। বলা হয়েছে, ‘২৩ এপ্রিল ভারতীয় বিবৃতিতে থাকা হুমকির নিন্দা করছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি)। ভারত বারবার আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে। পাকিস্তানসহ একাধিক দেশ তার প্রমাণ পেয়েছে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নিরাপত্তার ওপর যেকোনো হুমকির বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে কাজে লাগিয়ে পেহেলগামের মতো ঘটনা নিয়ে দোষারোপের খেলা বন্ধ করা উচিত ভারতের। এই ধরনের কৌশল কেবল উত্তেজনাই বৃদ্ধি করে।’
এরপর বিবৃতিতে আটটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে পাকিস্তান :
১. সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত রাখার ভারতের যে সিদ্ধান্ত, তা পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করছে। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং এটি একতরফাভাবে স্থগিত করা যায় না। পানি পাকিস্তানের মানুষের জাতীয় স্বার্থ। ২৪ কোটি মানুষের এই স্বার্থকে যেকোনো মূল্যে সুরক্ষিত করা হবে। সিন্ধু পানি চুক্তি অনুসারে পাকিস্তানে পানির প্রবাহ বন্ধের যেকোনো প্রচেষ্টাকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে দেখা হবে। সম্পূর্ণ শক্তির সঙ্গে এর জবাব দেওয়া হবে।
২. ভারতের বেপরোয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবকে উপেক্ষা করছে। ভারতের সঙ্গে সিমলা চুক্তিসহ সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিত রাখার অধিকার রয়েছে পাকিস্তানেরও। যতক্ষণ না ভারত পাকিস্তানের অন্দরে সন্ত্রাসকে উসকানি দেওয়া, আন্তর্জাতিক হত্যাকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক আইন ভাঙা বন্ধ না করছে, তত দিন চুক্তি স্থগিত থাকতে পারে।
৩. অবিলম্বে ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করবে পাকিস্তান। এই পথে ভারতের সব আন্ত সীমান্ত পরিবহন বন্ধ থাকবে। যারা বৈধ অনুমোদন নিয়ে সীমান্ত পেরিয়েছে, তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হচ্ছে।
৪. সার্ক ভিসা অব্যাহতি প্রকল্পের (এসভিইএস) অধীনে ভারতীয়দের যত ভিসা পাকিস্তান দিয়েছে, তা বাতিল করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু শিখ পুণ্যার্থীদের ভিসা। এসভিইএসের অধীনে যে ভারতীয়রা পাকিস্তানে এখন আছে, তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে।
৫. ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করল পাকিস্তান। তাদের ভারতে ফিরতে হবে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে। এই উপদেষ্টাদের সহযোগীদেরও ফিরে যেতে বলা হয়েছে।
৬. ভারতীয় দূতাবাসের সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ৩০ করা হয়েছে।
৭. ভারতীয় মালিকানাধীন বা ভারতে নিয়ন্ত্রিত সব বিমান সংস্থার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
৮. ভারতের সঙ্গে সব বাণিজ্য বন্ধ করে দিচ্ছে পাকিস্তান। অন্য কোনো দেশের পণ্যও পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে ভারতে যেতে পারবে না বা সেখান থেকে অন্য দেশে যেতে পারবে না।
এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় মোদির বাসভবনে জরুরি বৈঠকে বসেছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাসংক্রান্ত কমিটি (সিসিএস)। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে সেই বৈঠক হয়। পরে রাত ৯টা নাগাদ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সিসিএসের কর্মকর্তারা। পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন :
১. ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি। যত দিন না পাকিস্তান আন্ত সীমান্ত সন্ত্রাসের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করছে, তত দিন এই চুক্তি স্থগিত থাকবে।
২. অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। উপযুক্ত নথিপত্র নিয়ে যারা এই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে, তাদের ১ মে পর্যন্ত সময় দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে এই সীমান্ত দিয়েই তাদের ফিরে যেতে হবে।
৩. সার্ক ভিসা অব্যাহতি প্রকল্পের (এসভিইএস) অধীনে কোনো পাকিস্তানি নাগরিককে আর ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অতীতে এই ভিসায় প্রবেশের জন্য পাকিস্তানিদের যত অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা হচ্ছে। এই ভিসা প্রকল্পের অধীনে যেসব পাকিস্তানি এখন ভারতে আছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের দেশ ছাড়তে হবে।
তবে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করার ঘোষণা দেয় ভারত। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভারতের ইস্যু করা সব বৈধ ভিসা ২৭ এপ্রিল থেকে বাতিল করা হচ্ছে। ভারতে অবস্থানকারী সব পাকিস্তানি নাগরিককে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভারত ত্যাগ করতে হবে। পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ইস্যু করা শুধু মেডিক্যাল ভিসা ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
৪. ইসলামাবাদে উপস্থিত ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, নৌ উপদেষ্টা ও বিমানবাহিনী উপদেষ্টাকে ফিরিয়ে নিচ্ছে ভারত। তাদের সহকারীদেরও তুলে নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে নয়াদিল্লিতে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, নৌ উপদেষ্টা ও বিমানবাহিনী উপদেষ্টাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হচ্ছে। ভারত ছাড়ার জন্য তাদের এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে।
৫. ভারতীয় দূতাবাসের সদস্য সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ করা হচ্ছে। ১ মে থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনায় মোট ২৬ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় ও একজন নেপালি নাগরিক। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা