আন্তর্জাতিক ডেস্ক : তেলের দাম পড়ে গেছে। সৌদি আরবের উচ্চাকাঙ্ক্ষী বড় প্রকল্পগুলোতেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এরপরও রাজতান্ত্রিক এ দেশে যেন একটুও চিন্তার ছাপ নেই।
রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে অনুসারে, সৌদি আরব তেলশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে বলেছে যে দাম কম হলেও এর সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে নিতে পারবে তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিক থেকে এটা সত্যও। কারণ, সৌদি আরব এ মুহূর্তে এমন এক অবস্থানে আছে, যা অনেক দেশের কাছে ঈর্ষণীয়। বাস্তবতা হলো, উপসাগরীয় দেশটি তাদের আয়ের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে পারে।
সৌদি আরব চাইছে, তাদের অর্থনীতি যেন এককভাবে জ্বালানি আয়ের ওপর নির্ভরশীল না থাকে। ‘নিওম’-এর মতো বিশাল প্রকল্পগুলো আসলে তাদের সেই চিন্তাভাবনারই বাস্তব রূপ। তবে বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত সৌদি আরবের রাজস্বের প্রায় ৬১ শতাংশ আসে তেল বিক্রি থেকে।
সৌদি আরব হলো বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশের একটি, যাদের রাজস্ব জ্বালানির দামের সঙ্গে এতটা সরাসরি সম্পৃক্ত। অন্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোও তা–ই। এ কারণেই অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা যখন সৌদি আরবের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখেন বা বিশ্লেষণ করেন, তখন প্রায়ই একটি শব্দ ব্যবহার করেন—‘ব্রেক-ইভেন অয়েল পয়েন্ট’। এর মানে হলো, তেলের দামের এমন একটি স্তর নির্ধারণ করা, যেখানে থাকলে সৌদি আরবের বাজেট ঘাটতিও হয় না, আবার উদ্বৃত্তও থাকে না।
অক্সফোর্ড অ্যানালিটিকার তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে সৌদি আরবের বাজেটে ভারসাম্য রাখতে হলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে হবে।
তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
জ্বালানিবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সভার্সাল কনসালটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘সৌদি ইনক’ বইয়ের লেখক এলেন ওয়াল্ড মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘সৌদি আরবের বাজেটে ভারসাম্য রাখার দরকার নেই। তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে কত ডলার হলে বাজেটে ভারসাম্য বজায় থাকবে, তা সৌদি আরবের নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে যে ধারণার কথা বলা হচ্ছে, সেই হিসাব দিয়ে তেলের দাম নিয়ে সৌদির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যাবে না।’
বাজেট ঘাটতি মেনে নিয়েই এগোচ্ছে সৌদি আরব। দেশটির ২০২৫ সালের বাজেটে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বা জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ ঘাটতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউট গত এপ্রিল মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, যদি ২০২৫ সালে তেলের গড় দাম ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলার হয়, তবে সৌদি আরবের বাজেট ঘাটতি বেড়ে ৫৬ বিলিয়ন ডলার বা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ঘাটতির আভাস সত্ত্বেও আপাতত স্বস্তিতে আছে সৌদি আরব।
বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কায় তেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার কারণেও বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে। কারণ, চুক্তি হলে ইরানি তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তখনো তেলের দামের ওপর প্রভাব পড়বে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কায় তেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বড় ধরনের বাজেট ঘাটতি একটি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাজেট ঘাটতি কমিয়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে গত কয়েক মাসে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি নিয়ে বড় ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে এক অনন্য অবস্থানে আছে। কারণ, ডলার বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা। বিশ্লেষকদের মতে, এ অবস্থানই যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় শিবিরের প্রেসিডেন্টদের অতিরিক্ত খরচের ক্ষেত্রে একটি নিরাপদ পথ তৈরি করে দিয়েছে।
সৌদি আরব তো আর যুক্তরাষ্ট্র নয়। তবে বাজেট ঘাটতি সত্ত্বেও নিজেদের চালানোর মতো অবস্থা দেশটির আছে।
চলতি মাসে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস সৌদি আরবের ক্রেডিট রেটিং ‘এ প্লাসে’ উন্নীত করেছে। এ রেটিং দেশটিকে চীন ও জাপানের সমপর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি, যা যেকোনো বৈশ্বিক সংকটে প্রতিরোধ গড়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। সৌদি আরবের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৩০ শতাংশ, যা অন্য উদীয়মান অর্থনীতির তুলনায় অনেকটা কম।
স্বল্পমেয়াদি অর্থের চাহিদা মেটাতে ঋণ করছে সৌদি আরব। ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক ঋণ ইস্যুর দিক থেকে চীনকে পেছনে ফেলেছে দেশটি। বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা ২০২৫ সালেও অব্যাহত থাকবে।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে বিনিয়োগের জন্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি আমরা। এশীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে মার্কিন ঋণ বিক্রি করার মধ্য দিয়ে সৌদি আরব লাভবান হবে।
আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার টিম ক্যালেন বলেন, সৌদি আরব এ বছর এখন পর্যন্ত ডলার ও ইউরোতে ১৪ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যেরও বেশি ঋণ ইস্যু করেছে। বছর শেষ হওয়ার আগেই ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।
ক্যালেন গত মাসে লিখেছিলেন ‘সৌদি আরব এখনো শক্তিশালী আর্থিক অবস্থানে থাকায় বড় বাজেট ঘাটতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে অর্থায়নের কোনো সমস্যা হবে না। তবে তেলের দাম কম হলে, ঋণদাতারা হয়তো চলতি বছরের শুরুর দিকের তুলনায় বেশি হারে সুদ নেবে।’
সৌদি আরবের খরচের পরিমাণ অনেক। সেই খরচের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। এর মধ্য দিয়ে রাজতান্ত্রিক দেশটিতে অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটছে। চলতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ঋণ তুলেছে সৌদি আরব।
তা সত্ত্বেও, সৌদি সরকারকে নিওম প্রকল্পে ব্যাপক কাটছাঁট করতে হয়েছে। প্রথমে এটিকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারের মেগাসিটি প্রকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আয়োজকেরা বলেছিলেন, এ প্রকল্প নিউইয়র্ক সিটির চেয়ে ৩৩ গুণ বড় হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ নিওম শহরে ১৫ লাখ মানুষের বসবাস হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। তবে সৌদি কর্মকর্তারা এখন বলছেন, শহরটিতে বসবাসকারীর সংখ্যা ৩ লাখের কম হবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে এত বড় প্রকল্পটির মাত্র ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার অংশের কাজ শেষ হবে।
এ অবস্থায়, গত সোমবার ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের খবরে বলা হয়, নিওম প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকল্পটি নিয়ে ‘বিস্তৃত পর্যালোচনা’ শুরু করেছেন।
রাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা হরাইজন এনগেজের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পরিচালক অ্যান্ড্রু ফারান্ড মনে করেন, নিওমের মতো প্রকল্পগুলোতে কাটছাঁট আনার মধ্য দিয়ে সৌদি আরব একটি বাস্তবতা স্বীকার করে নিচ্ছে। তা হলো, তাদের ঋণের চাহিদা এখনো বেশি, তবে তা সীমাহীন নয়।
মিডল ইস্ট আইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অ্যান্ড্রু ফারান্ড বলেন, ‘সৌদি আরব অন্য উদীয়মান অর্থনীতির তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ঋণের জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে তারা অনেক সময় পাবে। তবে সময়ের একটা সীমা তো আছেই।’
বাজেট ঘাটতি মেনে নিয়েই এগোচ্ছে সৌদি আরব। দেশটির ২০২৫ সালের বাজেটে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বা জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ ঘাটতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকিতে সৌদি আরবের অর্থনীতিতেও ধাক্কা লেগেছে। কারণ, এ হুমকি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এতে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে। তবে সৌদি আরব যখন বৈশ্বিক ঋণবাজারে ঢোকার চেষ্টা করছে, তখন ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্যনীতি তাদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।
আরবিসি ব্লুবে-এর উদীয়মান বাজারসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ টিমোথি অ্যাশ মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, এশিয়ার ক্রেতারা এত দিন ধরে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডকে নিরাপদ বিনিয়োগের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতেন। তবে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ ও মার্কিন ডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তাঁদের সে আস্থা নষ্ট করে দিয়েছে।
টিমোথি আরও বলেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলোতে বিনিয়োগের জন্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি আমরা। এশীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে মার্কিন ঋণ বিক্রি করার মধ্য দিয়ে সৌদি আরব লাভবান হবে।’