রবিবার, ১১ মে, ২০২৫, ০১:৩৩:৫০

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যে বড় লাভ হলো চীনের

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যে বড় লাভ হলো চীনের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা পুরো বিশ্বে উদ্বেগ জাগালেও লাভের উৎস তৈরি হয়েছে চীনের জন্য। সবশেষ তিন-চারদিনে দুদেশের সামরিক সংঘাত যেন সৌভাগ্য হয়ে ধরা দিয়েছে সুযোগসন্ধানী এ প্রতিবেশীর কাছে। বিশ্ব মানচিত্রে উঠতি সুপার পাওয়ার এই দেশটির জন্য একটি সম্ভাব্য মূল্যবান গোয়েন্দা তথ্যের উৎস হয়ে উঠেছে নতুন করে চড়াও এ বৈরিতা। খবর রয়টার্সের।

শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ বার্তাসংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত-পাকিস্তানের সামরিক লড়াই বেইজিংয়ের জন্য হয়ে উঠেছে বাস্তব যুদ্ধের পরীক্ষাগার—বিশ্বে চীনা সামরিক প্রযুক্তির সক্ষমতা কতটা কার্যকর, তাও প্রথমবারের মতো পরখ করার সুযোগ পেয়েছে বেইজিং। একইসঙ্গে বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সামরিক প্রযুক্তির সক্ষমতা ও দুর্বলতার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের সুযোগও পেয়ে গেছে তারা। তার উপর চীনা যুদ্ধবিমান দিয়ে পাকিস্তানের হামলায় ভারতের অহংকার বলে পরিচিত রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবরে বেড়ে গেছে বেইজিংয়ের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের শেয়ারমূল্য। সেইসঙ্গে হুহু করে বাড়তে শুরু করেছে চীনা প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যও।

প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, চীনের সামরিক আধুনিকীকরণ এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা এখন সীমান্ত ঘাঁটি, ভারত মহাসাগরে নৌবহর মোতায়েন এবং মহাকাশ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের পদক্ষেপ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নিল বলেছেন, গোয়েন্দা দৃষ্টিকোণ থেকে এটি (ভারত-পাকিস্তান সংঘাত) চীনের জন্য নিজেদের সীমান্ত ঘেঁষে একেবারে অপ্রত্যাশিত এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, যেখানে তাদের একটি সম্ভাব্য প্রধান প্রতিপক্ষ জড়িত।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তা বলেছেন, চীনের তৈরি জে-১০সি নামে একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভারতের অন্তত দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ভারতের ওই দুই যুদ্ধবিমানের একটি ফ্রান্সের তৈরি রাফাল। অবশ্য, ভারত তাদের কোনো যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার কথা এখনো স্বীকার করেনি। তবে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জে-১০সি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করার কথা নিশ্চিত করেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, আকাশযুদ্ধ সব দেশের সামরিক বাহিনীর জন্যই বিরল এক সুযোগ। এই যুদ্ধের মাধ্যমে তারা নিজেদের বৈমানিক ও যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি সক্রিয় যুদ্ধে আকাশ থেকে আকাশে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র কতটা কার্যকর, তা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান এবং সেখান থেকে পাওয়া জ্ঞানের আলোকে নিজেদের বিমানবাহিনীকে ভবিষ্যত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে পারেন।

প্রকৃতপক্ষে পারমাণবিক শক্তিধর ভারত এবং চীনকে দীর্ঘদিন ধরেই কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে। হিমালয় অঞ্চলে ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে দুই দেশের। ১৯৫০-এর দশক থেকেই সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে এবং ১৯৬২ সালে চীন ও ভারত একবার সংক্ষিপ্ত সংঘাতে জড়িয়েছিল।

চীন-ভারত সীমান্তে সর্বশেষ অচলাবস্থার সূত্রপাত হয়েছিল ২০২০ সালে। ওই অচলাবস্থা কিছুটা প্রশমিত হয় গত অক্টোবর মাসে, যখন উভয় পক্ষ সীমান্তে টহল সংক্রান্ত এক চুক্তিতে পৌঁছায়। প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় পক্ষই সীমান্তজুড়ে নিজেদের সামরিক স্থাপনা ও সক্ষমতা জোরদার করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও এর বাইরে চীন আকাশ থেকে গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের ওপরও অধিক গুরুত্ব দেয়।

লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে চীনের ২৬৭টি স্যাটেলাইট কার্যকর রয়েছে। এর মধ্যে ১১৫টি গোয়েন্দা নজরদারি ও পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। আরও ৮১টি সামরিক ইলেকট্রনিক ও সিগন্যাল তথ্য পর্যবেক্ষণ করে। এটি এমন একটি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, যার মাধ্যমে ভারতসহ আঞ্চলিক সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অনেকটা পেছনে ফেলে দিয়েছে চীন। এখন সক্ষমতার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীনের স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের অবস্থান।

হাওয়াই প্যাসিফিক ফোরাম থিঙ্কট্যাঙ্কের সহযোগী গবেষক আলেকজান্ডার নিল বলেন, মহাকাশে এবং ক্ষেপণাস্ত্র অনুসরণের ক্ষেত্রে চীন এখন অনেক শক্তিশালী। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেগুলোর ওপর নজরদারি করতে সক্ষম।

এদিকে, চীনের সঙ্গে একটি ‘সর্বাত্মক কৌশলগত, সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব’ আছে পাকিস্তানের। এর ফলে, দুই দেশের মধ্যকার গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে বড় ধরনের সমস্যায় আছে ভারত। একদিকে ভারতের সঙ্গে যেমন আমেরিকার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, তেমনি পাকিস্তান পুরোপুরি ঝুঁকে পড়েছে চীনের দিকে। চীন-পাকিস্তান যৌথ সামরিক মহড়া ও অস্ত্র উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক এখন একটি কৌশলগত জোটে রূপ নিয়েছে।

যদিও চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে না বলে দাবি ভারতের। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) স্কাই নিউজকে বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে মাথাব্যথা নেই ভারতের। চীনের জন্য তার সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন, যার মধ্যে আমরাও অন্তর্ভুক্ত।

এদিকে চীনা জে-১০সি যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রাফাল ধ্বংস করা হয়েছে, এমন খবর একটি ‘শক্তিশালী বিজ্ঞাপন’ হয়ে উঠেছে চীনের জন্য। সিএনএন বলছে, ঘটনা সত্যি হলে এই প্রথম কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে রাফায়েল সরাসরি ধ্বংস হলো। অবশ্য, খবরে সত্যি হোক কিংবা ভুয়া, চীনে পাকিস্তানের ব্যবহৃত জে-১০সি এবং জেএফ-১৭ তৈরি করা চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের শেয়ারমূল্য ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে। এছাড়া, অনেক দেশ যারা নিষেধাজ্ঞার মুখে পশ্চিমা প্রযুক্তি কিনতে পারে না, তারা এখন চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো চীনের সম্ভাব্য বাজার হয়ে উঠেছে সমরাস্ত্র বিক্রির জন্য।

চীনের তৈরি জে-১০সি মূলত আধুনিক অস্ত্র ও এভিয়নিক্সসহ ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে বিবেচিত, যা রাফালের সমতুল্য। পাকিস্তান ২০২২ সালে প্রথম এই বিমান হাতে পায়। পাকিস্তান তাদের জেএফ-১৭ ব্লক বিমানেও চীনের উন্নত পিএল-১৫ মিসাইল ব্যবহার করছে, যা ২০০-৩০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে