রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫, ০৮:০২:০৬

ভারতের মাথায় হঠাৎ বজ্রপাত, অন্যদিকে খুশির জোয়ার বইছে বাংলাদেশে!

ভারতের মাথায় হঠাৎ বজ্রপাত, অন্যদিকে খুশির জোয়ার বইছে বাংলাদেশে!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের মাথায় হঠাৎ বজ্রপাত, অন্যদিকে খুশির জোয়ার বইছে বাংলাদেশে! ভারতের ‘নিটওয়্যার রাজধানী’ তিরুপ্পুরে রপ্তানিকারকরা এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ৫০ শতাংশ শুল্কের প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের শুল্কারোপের জেরে বহু ক্রয়াদেশ স্থগিত হচ্ছে, অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে অথবা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনামের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কাছে চলে যাচ্ছে, যাদের ওপর আরোপিত শুল্কহার তুলনামূলক কম।

ক্রয়াদেশ হারাচ্ছে ভারত
তিরুপ্পুরের এক রপ্তানিকারক জানান, তার নিয়মিত মার্কিন চালান এরই মধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছে। আরেকজন বলেন, তার মার্কিন ক্রেতা গ্রীষ্মকালীন অর্ডার নিশ্চিত করার আগে ‘অপেক্ষা করতে’ বলেন। তৃতীয়জন বলেন, আগে ক্রেতারা রপ্তানিকারকদের ২৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির বোঝা নিজেরা বহন করতে বলতো—এখন যা এক লাফে দ্বিগুণ হয়েছে।

ভারতের ওপর আগের শুল্কের সঙ্গে নতুন শুল্ক যোগ হয়ে কিছু বোনা পোশাকের ক্ষেত্রে কার্যকর হার দাঁড়াচ্ছে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে এসব পণ্যের দাম আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অন্তত ৩৫ শতাংশ বেশি হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে এটিকে কেবল ‘বড় ধাক্কা’ মনে করা হয়েছিল, এখন রপ্তানিকারকরা তাকে ‘ডি ফ্যাক্টো বাণিজ্য অবরোধ’ হিসেবে দেখছেন।

এই শুল্ক আঘাত এমন সময়ে এসেছে যখন তামিলনাড়ুর টেক্সটাইল শিল্পাঞ্চল মার্কিন অর্ডার পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর ও করুর মিলে ১২ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ এই শিল্পে কাজ করেন এবং বছরে ৪৫ হাজার কোটি রুপির পোশাক রপ্তানি হয়।

মাথায় হঠাৎ বজ্রপাত
কয়েক সপ্তাহ আগেই ভারতে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল– যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং চীন (১২৫ থেকে ১৪৫ শতাংশ) ও মিয়ানমারের (৪০ শতাংশ) ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের কারণে ভারতীয় পণ্যের প্রতি মার্কিন ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়বে। এ আশায় অনেক রপ্তানিকারক নতুন যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ করেছিলেন বাড়তি চাহিদা সামাল দেওয়ার জন্য।

কিন্তু সেই আশা এখন বদলে যাচ্ছে হতাশায়; বিশেষ করে প্রতিশোধমূলক শুল্কের ভারে—যেখানে চীনের হার এখন ৩০ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা হলে তা আরও কমতে পারে।

‘এটি বড় ধাক্কা,’ বলেন তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম সুব্রামানিয়ান। স্বতন্ত্র রপ্তানি কোম্পানিগুলো আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্রেতারা এরই মধ্যে আমাদের কিছু শুল্ক বহন করতে বলছেন। আমাদের মুনাফা মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এ অবস্থায় এ খরচ কীভাবে বহন করবো?

তার মতে, তিরুপ্পুরের ৩০ শতাংশ রপ্তানি যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বৈচিত্র্যময় ক্রেতাভিত্তি কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে, তবে সেটিও কষ্ট ছাড়া নয়। ‘অব্র্যান্ডেড ক্রেতারা সঙ্গে সঙ্গে সরে যাবে। ব্র্যান্ডেডরা হয়তো থাকবেন সামাজিক মানদণ্ড ও কার্যপ্রণালির কারণে। কিন্তু আমাদের কিছুদিন রক্তক্ষরণ হবেই।’

জেঁকে বসেছে চাকরি হারানোর শঙ্কা
টেক্সটাইল শ্রমনির্ভর খাত, তাই বাজার সংকুচিত হলে চাকরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে। রপ্তানি ১০–২০ শতাংশ কমলে তিরুপ্পুর, করুর ও কোয়েম্বাটুর—এই তিন বাণিজ্য কেন্দ্রে এক থেকে দুই লাখ চাকরি ঝুঁকিতে পড়তে পারে, সেটিও আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই।

শুধু তিরুপ্পুরই ৪০ হাজার কোটি রুপির নিটওয়্যার রপ্তানি করে, ওয়ালমার্ট, গ্যাপ, কস্টকোর মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে সরবরাহ দেয় এবং ভারতের নিটওয়্যার রপ্তানির ৫৫ শতাংশ জোগান দেয়। আগামী অর্থবছর ভারতের এই খাত ১০-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করেছিল। কিন্তু এখন বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশেষত তুলা ও বোনা পোশাকের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রগামী অর্ডার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

ক্ষতির ব্যাপকতা
প্রভাব শুধু পোশাকেই সীমাবদ্ধ নয়। গৃহস্থালি টেক্সটাইলের জন্য পরিচিত কোয়েম্বাটুর ও করুরেও অর্ডার স্থবির হয়ে পড়েছে। সাউদার্ন ইন্ডিয়া মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কে সেলভারাজু জানান, বিছানার চাদর ও তোয়ালে, যা সাধারণত অক্টোবরের মধ্যে অর্ডার হয়—এর গ্রীষ্মকালীন বুকিংও ক্রেতারা পিছিয়ে দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, যারা আগাম অনুসন্ধান করেছিলেন, তারা এখন বলছেন ‘অপেক্ষা করুন’। সেলভারাজু আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই মৌসুম মিস করলে আমরা পুরো সিজনই হারাবো।

করুর একাই বছরে প্রায় নয় হাজার কোটি রুপির গৃহস্থালি টেক্সটাইল রপ্তানি করে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৯০০ কোটি রুপি সরাসরি রপ্তানি। কোয়েম্বাটুরের কারখানাগুলো বিপুল পরিমাণ তুলার তোয়ালে ও রান্নাঘরের লিনেন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। কিন্তু এখন তারা বাড়তি শুল্কের বোঝায় কাহিল।

‘এটি শুধু একবারের শুল্ক বৃদ্ধির বিষয় নয়, এটি এমনিতেই দুর্বল বাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে,’ বলেন সেলভারাজু। তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের তুলার ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং জিএসটি ডিউটি ইনভারশন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে।

পলিয়েস্টার কাঁচামালে কর ১৮ শতাংশ, সুতোতে ১২ শতাংশ, কিন্তু তৈরি পোশাকে ৫ শতাংশ। এতে রপ্তানি খরচ ৬–৭ শতাংশ বেড়ে যায়, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের এমন কর কাঠামো নেই, বলেন তিনি।

কাঁচামালের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন
এদিকে, এ বছর ব্রাজিল থেকে ভারতে আমদানি হওয়া তুলার ৪৫ শতাংশের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সেলভারাজু কেন্দ্রীয় সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন তুলাকেন্দ্রিক একটি চুক্তি করতে, যাতে মার্কিন তুলার শুল্কমুক্ত আমদানি করা যায় এবং সেখান থেকে তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা যায়।

এগিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীরা
বিশ্ব টেক্সটাইল বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র; ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা এমন শাস্তিমূলক শুল্কের মুখে পড়ছে না। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর শুল্কহার মোট ৩৫-৩৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৯-২১ শতাংশ, ভিয়েতনামে ২০-২১ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া, যেখানে আগে ৪৯ শতাংশ ছিল—১ আগস্ট থেকে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। সেই তুলনায় ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্কহার একেবারেই আলাদা ও নজিরবিহীন।

তিরুপ্পুরের এক ব্যবসায়ী স্বীকার করেন, তার চালান পাকিস্তানে চলে গেছে। ‘তারা সম্ভবত ভালো দাম দিয়েছে,’ তিনি বলেন। ‘অর্ডার হাতছাড়া হলো।’

সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ
তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম সুব্রামানিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। তাদের ২০ শতাংশ শুল্কহার মানে তারা অনেক সাশ্রয়ী, বিশেষ করে আপনার মুনাফা যখন মাত্র ৫ শতাংশ।

ভারতের জন্য এখন এই মুনাফা প্রায় নেই বললেই চলে। মোট শুল্ক ৬৪ শতাংশ হওয়ায় অব্র্যান্ডেড মার্কিন ক্রেতারা এরই মধ্যে সস্তা বিকল্পে চলে যাচ্ছেন। ‘তারা রাতারাতি সরে যায়,’ সতর্ক করেন সুব্রামানিয়ান।

এ অবস্থায় ভারতের শিল্প নেতারা সরকারের কাছে তাৎক্ষণিক নীতি-সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। সেলভারাজু স্মরণ করিয়ে দেন, মহামারির সময় সরকার বাড়তি ক্রেডিট গ্যারান্টি–লিংকড স্কিম দিয়েছিল। এখন সেটি ফের চালু করার সময় এসেছে।

তিনি তুলার ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক বাতিল এবং কৃত্রিম তন্তুর ওপর জিএসটি পুনর্গঠনের দাবি জানান। ‘আমাদের রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে হলে কাঁচামালের ওপর কর ৫ শতাংশের নিচে আনতে হবে।’

ভারতীয় ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, এ দাবিগুলো উপেক্ষা করা হলে তারা স্থায়ীভাবে বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের কাছে—যারা এখন যুক্তরাষ্ট্রে আরও সস্তায় পণ্য সরবরাহ করতে পারছে। এর ধারাবাহিক প্রভাব—অর্ডার কমে যাওয়া, উৎপাদন সক্ষমতা অচল হওয়া ও চাকরি হারানো—এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

দ্রুত পদক্ষেপের দাবি
সেলভারাজু বলেন, মার্কিন ক্রেতারা এখনো আমাদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে চায়। তারা ভারতীয় তুলা ও কাজ পছন্দ করে। কিন্তু রাজনৈতিক ও নীতিগত প্রতিবন্ধকতা তাদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

তিরুপ্পুরের একটি মাঝারি আকারের কারখানার মালিক রামদাস বলেন, আগামী দু-তিন সপ্তাহই হবে নির্ধারণী সময়। এখনো অর্ডার বাতিল হয়নি, কিন্তু ভাবমূর্তি বদলাচ্ছে। সবাই সতর্ক।

সুব্রামানিয়ান মনে করেন, ভারত সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এ মন্দা সামলানো সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা কোভিড কাটিয়ে উঠেছি। এটাও কাটিয়ে উঠবো। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলছি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানাচ্ছি। সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে