মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫, ০২:০৬:১৩

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা ব্যক্তিদের ওপর কেন চড়াও হচ্ছে মোদি সরকার?

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা ব্যক্তিদের ওপর কেন চড়াও হচ্ছে মোদি সরকার?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বহু মুসলিম পুরুষকে গ্রেফতার করছে পুলিশ।  গ্রেফতারের পাশাপাশি তাদের কয়েকজনের বাড়িঘরও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।  গত মাস থেকে চলছে ভারতীয় পুলিশের এই অভিযান। 

এই অভিযানের মূল কারণ একটাই— পোস্টার, টি-শার্ট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ (আমি মুহাম্মদকে ভালোবাসি) লেখা, যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। 

কিন্তু ভারত কর্তৃপক্ষ বলছে, এই অভিব্যক্তি ‘জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি’।

অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর) জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২২টি মামলায় ২,৫০০ জনেরও বেশি মুসলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।  আর  বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে অন্তত ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

আসলে কী ঘটেছিল? 
গত ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের  উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর শহরে মুসলমানরা নবীজির জন্মবার্ষিকী ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করছিলেন।  সে সময় ওই এলাকায় একটি বোর্ড টানানো হয়, যাতে লেখা ছিল ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ (আমি মুহাম্মদকে ভালোবাসি)’। 

এই বোর্ডটি নিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলে কিছু স্থানীয় হিন্দু।  তাদের অভিযোগ, এটি উৎসবে নতুন সংযোজন, অথচ উত্তর প্রদেশের আইনে ধর্মীয় উৎসবে নতুন কিছু যোগ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। 

উল্লেখ্য, কানপুরের প্রায় ২০ শতাংশ জনসংখ্যা মুসলিম।

এসব বাসিন্দাদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ধর্মীয় ভিত্তিতে বৈরিতা ছড়ানোর মতো গুরুতর অভিযোগে প্রায় দুই ডজন মুসলমানের বিরুদ্ধে মামলা করে। এই অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষোভ

কানপুরের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদের তীব্র সমালোচনা শুরু হয় এবং বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য রাজ্যেও— দক্ষিণের তেলেঙ্গানা, পশ্চিমের গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে, এবং উত্তরের উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরে।  ‘ ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা পোস্টার, ব্যানার ও সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর গত ২৬ সেপ্টেম্বর কানপুর থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরে বেরেলি শহরে মুসলিমদের গ্রেফাতারের প্রতিবাদে এক স্থানীয় ইমামের আহ্বানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।  এই বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। 

এ ঘটনার জেরে পুলিশ ইমাম তাওকির রাজা, তার আত্মীয়স্বজন ও সহযোগীসহ ৭৫ জনকে গ্রেফতার করে।  স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের চারটি ভবন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলে।

এটা কি বেআইনি?

ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও তা প্রকাশের অধিকার নিশ্চয়তা দেয়। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে, 

প্রত্যেক ব্যক্তির তার ধর্ম পালন ও প্রকাশের স্বাধীনতা আছে।  এছাড়া নাগরিকরা ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করেন—যতক্ষণ না তা সরাসরি সহিংসতা বা ঘৃণা উসকে দেয়।

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ স্লোগানকে কেন্দ্র করে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে অভিযোগ এনেছে তা মূলত বড় জনসমাবেশে ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ সৃষ্টি বা ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য প্রযোজ্য। এই এই আইন এমন মানুষদের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয়েছে, যারা কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন বা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা টি-শার্ট পরেছেন।

নাগরিক অধিকার সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর)- এর জাতীয় সমন্বয়ক নাদিম খান এসব মামলা পর্যবেক্ষণ করছেন।  তিনি এর আগেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশ বা বাড়িঘর বুলডোজারের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর আইনি লড়াই করেছেন।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, কর্তৃপক্ষ সচেতনভাবে এমন আইনের আশ্রয় নিচ্ছে, যেগুলো সরাসরি ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বাক্যটিকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে না, বরং যেসব ব্যক্তি এই বাক্য ব্যবহার করেছেন বা সংশ্লিষ্ট পুলিশি দমননীতির প্রতিবাদ করেছেন, তাদের অন্য অভিযোগে অভিযুক্ত করছে।

নাদিম খান বলেন, ‘তারা জানে ‘‘আই লাভ মুহাম্মদ’’ বলা কোনো অপরাধ নয়—এমন কোনো আইনই নেই।’

তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘ভারতের সর্বত্র হিন্দু দেবতাদের অস্ত্র হাতে থাকা ছবি দেখা যায়। তাহলে কি সেসব চিত্র মুসলমানদেরও অপমানিত বা হুমকিগ্রস্ত বোধ করাবে?‘

তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকে বুঝতে হবে, সরকার কোনো ধর্মকে এভাবে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে না।’

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সূচকে ভারত ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে।

মানুষের মতপ্রকাশ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা অত্যন্ত উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে বলে মন্তব্য করেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার বোর্ড চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল।

প্যাটেল বলেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো শান্তিপূর্ণ ও অহিংস অভিব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু করা ভারতীয় সংবিধান বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে অপরাধের মানদণ্ড পূরণ করে না।

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের ভূমিকা হলো নাগরিকদের অধিকার সমানভাবে রক্ষা করা, বিশ্বাসের প্রকাশে হস্তক্ষেপ করা নয়।’ 

নির্দিষ্ট ধারা বা প্রবণতা আছে কি?

সমালোচকদের মতে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ অভিযানটি আসলে ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান প্রান্তিকীকরণ, সহিংসতা এবং আইনি হয়রানির ধারাবাহিকতারই সর্বশেষ উদাহরণ।

গত ১১ বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা আকাশচুম্বী বৃদ্ধি পেয়েছে।  নথিভুক্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যেখানে ঘৃণামূলক বক্তৃতার ঘটনা ছিল ৬৬৮টি, সেখানে গত বছর (২০২৪) প্রায় ৭৪ শতাংশ বেড়ে তা হয়েছে ১,১৬৫টি।  আরে এসব ঘটনার বড় অংশই ঘটেছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে, অথবা সেসব এলাকায় যেখানে নির্বাচন আসন্ন ছিল।

দিল্লিভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিম আলি বলেন, এখন স্থানীয় পর্যায়ের ছোটখাটো হিন্দু-মুসলিম বিরোধ দ্রুতই জাতীয় ইস্যুতে রূপ নেয়।

তিনি বলেন, ‘এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি হয়েছে— অনুগত মূলধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সংগঠন পর্যন্ত— ঘৃণার বার্তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেয়।’

কানপুরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ঘটনার পর, মোদির নিজের নির্বাচনি এলাকা বারাণসীতে বিজেপি নেতারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে ‘আই লাভ বুলডোজার’ লেখা পোস্টার টানান। মূলত অভিযুক্ত মুসলমানদের  ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙার ঘটনাকে ইঙ্গিত করে এই স্লোগান তোলা হয়।

তরুণ মুসলিমদের ওপর এর প্রভাব 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রশিদ কিদওয়াই বলেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ইস্যুটি ‘মূলত রাজনৈতি, ধর্মীয় নয়’। 

তিনি বলেন, ভারতে মুসলমানদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, ক্রমবর্ধমান হতাশা দেখা যাচ্ছে।  কারণ তারা দেখছে,  সংস্কৃতি, পরিচয় বা খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে একই নিয়ম সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়।

এপিসিআর-এর তথ্যমতে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ইস্যুতে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বা যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অনেকেই তরুণ মুসলমান।  এদের মধ্যে অনেকই শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্ট দেওয়ার কারণে গ্রেফতার হয়েছে। 

দিল্লিভিত্তিক বিশ্লেষক আসিম আলি বলেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো অভিব্যক্তির ওপর দমননীতির এই ধারা তরুণ মুসলমানদের আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।

তিনি আরও বলেন, ‘এখন ভবিষ্যত কেমন হবে- তা কল্পনা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।  ঘৃণার স্রোত দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে।’

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে