আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশগুলোর একটি ভারত। ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ভরপুর একটি দেশ। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠী একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশটির সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব রেখেছে। ইসলামী সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক কেন্দ্র থেকে শুরু করে আধুনিক মহানগর পর্যন্ত, ভারতের অসংখ্য শহরে আজও ইসলামী ঐতিহ্যের স্পন্দন টের পাওয়া যায়।
স্থাপত্য, খাবার কিংবা উৎসব—সব ক্ষেত্রেই মুসলিমদের অবদান স্পষ্ট। নিচে এমন ১০টি ভারতীয় শহরের পরিচয় তুলে ধরা হলো, যেখানে মুসলমানরা জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এবং যেগুলো ইসলামী সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারক-বাহক হিসেবে পরিচিত।
১. হায়দরাবাদ, তেলেঙ্গানা
‘সিটি অব পার্লস’ নামে পরিচিত হায়দরাবাদ মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য কেন্দ্র। কুতুব শাহী ও আসাফ জাহী রাজবংশের শাসনকালে গড়ে ওঠে এর সমৃদ্ধ ইতিহাস।
বিশেষ দিক : চারমিনার, মক্কা মসজিদ, গোলকোন্ডা ফোর্টসহ ঐতিহাসিক স্থাপনা; হায়দরাবাদি বিরিয়ানি, হালিম ও শির খুরমার মতো বিখ্যাত খাবার।
জনসংখ্যা : শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ বাসিন্দাই মুসলমান।
২. লখনউ, উত্তর প্রদেশ
আওধের নবাবি ঐতিহ্যের শহর লখনউ ভারতের অন্যতম সংস্কৃতিমণ্ডিত নগরী। নবাব আমল থেকে শহরটি উর্দু সাহিত্য, কবিতা ও নৃত্যকলার জন্য বিখ্যাত।
বিশেষ দিক : বড়া ইমামবাড়া, ছোটা ইমামবাড়া ও রুমি দরওয়াজা; তুন্দে কাবাবি ও নিহারি শহরের ঐতিহ্যবাহী খাবার।
জনসংখ্যা : প্রায় ২৭ শতাংশ মুসলমান।
৩. কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
সংস্কৃতি ও ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই মহানগরেও রয়েছে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী। এখানকার মসজিদ, খাবার ও উৎসবগুলোতে ইসলামী ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট।
বিশেষ দিক : নাখোদা মসজিদ, টিপু সুলতান মসজিদ; বিখ্যাত কলকাতা বিরিয়ানি, মুঘলই পরোটা ও ফিরনি।
জনসংখ্যা : প্রায় ২০ শতাংশ মুসলমান।
৪. শ্রীনগর, জম্মু ও কাশ্মীর
কাশ্মীর উপত্যকার রাজধানী শ্রীনগর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইসলামী সংস্কৃতির মিলনস্থল। শহরটির প্রায় পুরো জনসংখ্যাই মুসলমান।
বিশেষ দিক : জামে মসজিদ, মুঘল গার্ডেন, শঙ্করাচার্য মন্দির; সুফি সংগীত ও কবিতায় ভরপুর সাংস্কৃতিক পরিবেশ।
জনসংখ্যা : মুসলমান ৯৫ শতাংশের বেশি।
৫. মুম্বাই, মহারাষ্ট্র
ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাই বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র। এখানকার মুসলিম সম্প্রদায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশেষ দিক : হাজি আলি দরগাহ, মাহিম দরগাহ; কীমা পাও, নিহারি, মালপুয়া ইত্যাদি জনপ্রিয় খাবার।
জনসংখ্যা : প্রায় ২০ শতাংশ মুসলমান।
৬. দিল্লি
ভারতের রাজধানী দিল্লি মোগল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতীক। এখানকার স্থাপত্য ও খাদ্য সংস্কৃতিতে সেই ইতিহাসের ছাপ এখনো বিদ্যমান।
বিশেষ দিক : জামে মসজিদ, কুতুব মিনার, হুমায়ুনের সমাধি; কারিমের মুঘলই খাবার ও উর্দু সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র।
জনসংখ্যা : প্রায় ১৩ শতাংশ মুসলমান।
৭. আলিগড়, উত্তর প্রদেশ
আলিগড় মুসলিম শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র, যেখানে অবস্থিত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (AMU)। শহরটির সাংস্কৃতিক জীবন ইসলামী শিক্ষা ও সাহিত্যকে ঘিরে গড়ে উঠেছে।
বিশেষ দিক : আলিগড় ফোর্ট, স্যার সায়েদ হাউস মিউজিয়াম; বিখ্যাত কাবাব ও বিরিয়ানি।
জনসংখ্যা : প্রায় ৪১ শতাংশ মুসলমান।
৮. ভোপাল, মধ্যপ্রদেশ
ভোপাল একসময় মুসলিম শাসক ‘বেগমদের’ অধীনে ছিল, যার ফলে এখানকার সংস্কৃতি ও স্থাপত্যে ইসলামী ঐতিহ্যের প্রভাব গভীর।
বিশেষ দিক : তাজ-উল-মসাজিদ, শওকত মহল; ভোপালি গোশত কোরমা ও কিমা শহরের ঐতিহ্যবাহী খাবার।
জনসংখ্যা : প্রায় ২৮ শতাংশ মুসলমান।
৯. মেরঠ, উত্তর প্রদেশ
ঐতিহাসিক এই শহরটি ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এবং এখানকার মুসলিম সমাজ সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয়।
বিশেষ দিক : জামে মসজিদ, সুরজকুণ্ড; নিহারি, বিরিয়ানি ও কাবাবের জন্য খ্যাত।
জনসংখ্যা : প্রায় ৩৪ শতাংশ মুসলমান।
১০. ঔরঙ্গাবাদ, মহারাষ্ট্র
মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নামে নামকৃত এই শহর ইসলামী ইতিহাস ও স্থাপত্যের অন্যতম কেন্দ্র।
বিশেষ দিক : বিবি কা মকবরা, ঔরঙ্গাবাদ গুহা; নান কলিয়া ও পাঠরি শহরের জনপ্রিয় খাবার।
জনসংখ্যা : প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান।
এই শহরগুলো যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
এই শহরগুলো শুধু জনসংখ্যাগত দিক থেকে নয়, ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী স্থাপত্য, সাহিত্য, সংগীত ও রন্ধনশৈলীতে তাদের অবদান অপরিসীম।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য :মুসলমানদের উপস্থিতি সাহিত্য, সংগীত ও উৎসবকে সমৃদ্ধ করেছে।
রন্ধনশৈলী : বিরিয়ানি, কাবাব, নিহারি, হালিমের মতো খাবারে মুসলিম রান্নার প্রভাব স্পষ্ট।
স্থাপত্য : প্রতিটি শহরে ইসলামী শিল্প ও স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন রয়েছে।
অর্থনীতি : মুসলমানরা শিক্ষা, বাণিজ্য ও শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
ভ্রমণ পরামর্শ
যারা এই শহরগুলো ভ্রমণ করতে চান, তারা স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ঘুরে দেখতে পারেন। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা বা রমজান মাসে গেলে উৎসবমুখর পরিবেশ উপভোগ করা যায়।
ভারতের এই মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলো দেশটির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত বহন করে। ইসলামী সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও আধুনিক জীবনের মিশেলে এই শহরগুলো ভারতীয় সমাজের এক অনন্য পরিচয় তুলে ধরে। সূত্র : হালাল টাইমস