আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চলতি বছরের শুরু থেকেই উত্থান-পতনে টালমাটাল দেশের স্বর্ণের বাজার। কখনও টানা বাড়ছে আবার কখনও টানা কমছে। উত্থান-পতনের এই প্রবণতায় চলতি বছর এখন পর্যন্ত স্বর্ণের দাম সমন্বয় হয়েছে ৮৩ বার। যা দেশের ইতিহাসে যে কোনো বছরে সর্বোচ্চ।
প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচুর্যের অপর নাম স্বর্ণ। একে বলা হয়, অর্থের সবচেয়ে স্থায়ী রূপ। হাজার বছর ধরে মূল্যবান এই ধাতুর চোখধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি আর চাকচিক্য মানুষকে অভিভূত করে চলেছে। হয়তো সে কারণেই এর মূল্য কখনও শূন্যে নামেনি; বরং দিন যত যাচ্ছে, ততই বাড়ছে মূল্য।
দেশের স্বর্ণের বাজার মূলত বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে-কমলে এর প্রভাব পড়ে দেশের বাজারেও। ফলে দেশে সমন্বয় করা হয় দাম। সবশেষ গত ২ ডিসেম্বর দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। ৮৩ বার দাম সমন্বয়ের মধ্যে ৫৬ বার দাম বাড়ানো হয়েছে, আর কমানো হয়েছে মাত্র ২৭ বার।
চলতি বছর স্বর্ণের বাজারে টানা উত্থান-পতন শুরু হয়েছিল দাম বৃদ্ধির প্রবণতা দিয়েই। গত ১৫ জানুয়ারি ভরিতে ১ হাজার ১৫৫ টাকা বাড়িয়ে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৩ টাকায়। এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ৭ দফায় বাড়ানো হয় স্বর্ণের দাম। যার মধ্যে গত ১, ৬, ১০, ১৭ ও ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতিবারই রেকর্ড ভেঙে দাম গড়েছে নতুন ইতিহাস। ২০ ফেব্রুয়ারি স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁড়ায় রেকর্ড ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৫ টাকায়।
তবে গত ২৩ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ১ মার্চ টানা ৩ দফায় কমানো হয় স্বর্ণের দাম। ৩ দফায় ভরিতে ৬ হাজার ১৮২ টাকা কমে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৩ টাকায়। এরপর গত ৪ মার্চ ভরিতে ৩ হাজার ৫৫৭ টাকা বাড়ানো হলেও গত ৮ মার্চ কমানো হয় ১ হাজার ৩৮ টাকা। দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৬২ টাকায়। তবে গত ১৬, ১৮, ২৫ ও ২৮ মার্চ টানা ৪ দফায় মোট ৭ হাজার ১০ বেড়ে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের ভরি গিয়ে ঠেকে রেকর্ড ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৭২ টাকায়।
এপ্রিল মাসের শুরুটা হয় দামের পতনের মধ্য দিয়ে। গত ৮ এপ্রিল ভরিতে ১ হাজার ২৪৮ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৪ টাকা। তবে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ভরিতে বাড়ানো হয় ২ হাজার ৪০৩ টাকা। দাম গিয়ে ঠেকে রেকর্ড ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭ টাকায়। এর ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে স্বর্ণের দামে বড় লাফ দেখে দেশবাসী। ভরিতে ৪ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়িয়ে ২২ ক্যারেটের এক ভরির দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ১৬৩ হাজার ২১৪ টাকা। তবে পরদিনই ভরিতে ১ হাজার ৩৮ টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৬২ হাজার ১৭৬ টাকা।
এরপর টানা ৪ দফায় মোট ১৫ হাজার ৭১২ টাকা স্বর্ণের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাজুস। গত ১৬, ১৯, ২১ ও ২২ এপ্রিল টানা ৪ দফায় দেশের বাজারে বাড়ে স্বর্ণের দাম। প্রতিবারেই রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়ে স্বর্ণের দাম। তবে ২৩ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে স্বর্ণের দামে বড় পতন ঘটে। সেদিন ভরিতে কমানো হয় ৫ হাজার ৩৪২ টাকা।
স্বর্ণের দামের উত্থান-পতনের ধারা অব্যাহত ছিল গত মে মাসেও। গত মে মাসের ৩ তারিখ ভরিতে ৩ হাজার ৫৭০ টাকা কমানো হলেও ৫ ও ৬ মে ভরিতে বাড়নো হয় যথাক্রমে ২ হাজার ৩১০ টাকা ও ৩ হাজার ৬৬২ টাকা। দাম গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৯৪৮ টাকা। তবে এরপর ৮, ১০ ও ১২ মে টানা ৩ দফা পতন ঘটে মূল্যবান এই ধাতুর দামে। এরপর গত ১৩ মে দাম বৃদ্ধি, ১৫ মে দাম হ্রাস এবং ১৭ ও ২১ মে, ৫ ও ১৪ জুন দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হয় দেশের স্বর্ণের বাজার।
তবে ২৪ ও ২৮ জুন ফের দেশের বাজারে কমানো হয় দাম। ১ জুলাই আবারও এ দফা দাম বাড়িয়ে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরির দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৭২ হাজার ১২৬ টাকা। এরপর ৭ জুলাই দাম হ্রাস, ২২ ও ২৩ জুলাই দাম বৃদ্ধি এবং ২৪ জুলাই ফের কমানো হয় স্বর্ণের দাম।
গত আগস্টে কিছুটা স্থিতিশীল ছিল বাজার। তখন ১ মাসেরও বেশি সময় পর ২৬ আগস্ট ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরিতে ১ হাজার ৫০ টাকা বাড়িয়ে সমন্বয় করা হয় দাম। আর ৩০ আগস্ট আরেক দফায় বাড়ানো হয় ১ হাজার ৬৬৭ টাকা। দাম গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৮ টাকা। এরপর ১, ৩, ৭, ৮, ৯ ও ১৬ সেপ্টেম্বর টানা বেড়েছে স্বর্ণের দাম। দাম পৌঁছায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬২২ টাকায়। তবে ১৭ সেপ্টেম্বর ভরিতে কমানো হয় ১ হাজার ৪৭০ টাকা। ২০ সেপ্টেম্বর ফের বাড়ানো হয় দাম। এরপর ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর দাম দুই দফাতেই দাম বেড়ে নতুন রেকর্ড করে দেশের স্বর্ণের বাজার।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ফের পতন স্বর্ণের বাজারে। তবে ২৯ সেপ্টেম্বর এবং ৪, ৬, ৭, ৮, ১৩, ১৪ ও ১৯ অক্টোবর টানা ৮ দফায় স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয় ২৪ হাজার ৪১৩ টাকা। এর মধ্যে প্রতিবারই দেশের বাজারে নতুন রেকর্ড গড়েছে স্বর্ণের দাম। ৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো দেশের বাজারে ২ লাখ টাকার মাইলফলক স্পর্শ করে স্বর্ণ। আর গত ১৯ অক্টোবর নির্ধারণ করা ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম।
তবে গত ২২ অক্টোবর দেশের বাজারে বড় পতন দেখে স্বর্ণ। ভরিতে ৮ হাজার ৩৮৬ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরির দাম নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৮ হাজার ৯৯৬ টাকা। এবার পতনের ধারায় যুক্ত হয় নতুন মাত্র। ২৬, ২৭ ও ২৮ অক্টোবর টানা ৩ দফায় কমানো হয় আরও ১৫ হাজার ১৮৭ টাকায়। দাম পৌঁছায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৯ টাকায়। এর মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর একদিনেই কমানো হয় ১০ হাজার ৪৭৪ টাকা। যা এখন পর্যন্ত দেশের বাজারে স্বর্ণের সবচেয়ে বড় পতন।
স্বর্ণের উত্থান-পতনের খেলা এখানেই শেষ নয়। পরদিন অর্থাৎ গত ২৯ অক্টোবর ফের ভরিতে ৮ হাজার ৯০০ টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ২ হাজার ৭০৯ টাকা। তবে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ফের কমানো হয় ২ হাজার ৬১৩ টাকা। এরপর ১, ১০, ১১ ও ১৩ নভেম্বর টানা ৪ দফায় দাম বাড়ানো হয় ১৩ হাজার ৬২৩ টাকা। কিন্তু গত ১৫ ও ১৮ নভেম্বর ফের টানা দুই দফায় কমানো হয় ৬ হাজার ৮১১ টাকা। দাম পৌঁছায় ২ লাখ ৬ হাজার ৯০৮ টাকায়।
এরপর গত ১৯ নভেম্বর দাম বৃদ্ধি, ২০ নভেম্বর দাম হ্রাস এবং ২৯ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর ফের দাম বৃদ্ধি ও সবশেষ ২ ডিসেম্বর দাম কমিয়ে সমন্বয় করা হয় দেশের স্বর্ণের বাজার। ২ ডিসেম্বর ভরিতে ১ হাজার ৫০ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৯৫ টাকা। বর্তমানে এই দামেই দেশের বাজারে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে।
স্বর্ণের দামে ঘনঘন দাম পরিবর্তন কেন?
বাজুস বলছে, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, যুদ্ধ পরিস্থিতি, ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার, স্বর্ণের রিজার্ভে পরিবর্তন, সরবরাহে সীমাবদ্ধতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের টালমাটাল অবস্থা ছিল বছরজুড়ে।
আর বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে উত্থান-পতনের কারণেই দেশের বাজারে ঘনঘন দাম পরিবর্তন করতে হয়েছে। গত বছর ৬২ বার দাম সমন্বয় করলেও এ বছর সেটি পৌঁছেছে ৮৩ বারে। অস্থিরতা চলতে থাকলে চলতি বছরের শেষ কয়েক দিনে আরও কয়েকবার দাম সমন্বয় হতে পারে।
২০২৬ সালে স্বর্ণের বাজার দর কেমন হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুদিন ধরেই স্বর্ণ ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে পরিচিত, তবে সম্প্রতি এটিকে অনেকে ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবেও দেখছেন। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, মার্কিন ডলার এবং ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার নিয়ে অনিশ্চয়তা চলমান থাকলে খুব শিগগিরই দাম ৫ হাজার ডলার পেরিয়ে যেতে পারে। তবে অস্থিরতা কমলে বাজার নিম্নমুখী হবে।
ব্যাংক অব আমেরিকা বলেছে, ২০২৬ সালে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্স ৫ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে, যেখানে গড় দাম থাকবে ৪ হাজার ৪০০ ডলার।