সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:৫৩:৫৭

একজন ‘প্রিন্স’-এর জন্য কাঁদি, ৫০০ শরণার্থীর জন্য নয়

একজন ‘প্রিন্স’-এর জন্য কাঁদি, ৫০০ শরণার্থীর জন্য নয়

নিউজ ডেস্ক: সংবাদ লেখায় আমাদের নৈতিকতার কিছু কি হারিয়ে গেছে? গত সপ্তাহে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬৪ আফগান নাগরিক। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৪০ জন। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী, যারা রাজধানীকে রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের খুব কাছেই তালেবানরা এ হামলা চালিয়েছে। এতে কয়েকটি পরিবারের সবাই মারা গেছেন। তাদের কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি। স্থানীয় টেলিভিশনে দেখানো ফুটেজে দেখা গেছে, মা, তার স্বামী ও তিন সন্তানের পুরো একটি পরিবার মিলি সেকেন্ডের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। শহরের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস থেকে বলা হয়েছে, তাদের সব অ্যাম্বুলেন্স (১৫টি) উদ্ধার অভিযানে লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্সে এত বেশি আহত ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল যে, এর পেছনের দরজার পাল্লা এক সময় খুলে যায়। এখন আফগানিস্তান হলো সেই দেশ, যেখানে আমরা ও আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশীদাররা শরণার্থীদের ফেরত পাঠিয়ে তুষ্ট হচ্ছি। আর বলছি কাবুল ও এর আশপাশের প্রদেশ এখন নিরাপদ। অবশ্যই এটা একটি ডাহা মিথ্যা কথা। যেমন ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের আগে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের কথা বলা হয়েছিল অসৎ উদ্দেশ্যে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তাদেরকে আমরা ফেলে যাবো না। সোভিয়েত যুুদ্ধের পর তাদেরকে যেভাবে আমরা ভুলে গিয়েছি সেভাবে ভুলবো না। অবশ্য ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের দেয়া সেই প্রতিশ্রুতির কোনো মূল্যই নেই। গত সপ্তাহে আফগানিস্তানের টেলিভিশনে আরেকটি খবর দেয়া হয়েছে। তাতে তাদের ভবিষ্যৎ কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে পারে তা তুলে ধরা হয়। দুজন আমেরিকানকে হত্যার জন্য সবুর নামে এক যুবককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সে আদালতে বলেছে, এজন্য তার কোনো অনুশোচনা নেই। সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের সামাজিক মিডিয়ায় ওই যুবকের পক্ষে সমর্থন উপচে পড়ে। একজন বলেন, ওই যুবকই হলেন খাঁটি আফগান। আরেকজন বলেন, তিনি প্রকৃত আফগান। কিন্তু এই সপ্তাহে মারা গেছেন সংগীতশিল্পী প্রিন্স। তারপর রয়েছে সর্বশেষ ভূমধ্যসাগরীয় বিপর্যয়। একটি বড় বোটে ছিলেন মিশরীয়, ইথিওপিয়ান, সোমালিয়ার মানুষ ও সুদানিরা। একটি ছোট বোট থেকে তাতে আরও শরণার্থী তাতে তুলে দেয়ার পর ওই বোটটি ডুবে মারা গেছেন ৫০০ শরণার্থী ও অভিবাসী। যারা বেঁচে আছেন তাদেরকে গ্রিসে নামানো হয়েছে। তাদের অনেকে নিজের পরিবারকে ডুবে মরতে দেখেছেন। কিন্তু তাদের ডুবে যাওয়ার কোনো ছবি নেই। অবশ্যই তাদের কোনো ময়নাতদন্তও নেই। ছোট্ট আয়লান কুর্দির মতো সমুদ্র তীরে ভেসে আসেনি কারো মৃতদেহ। তাই কোনো ক্যামেরাও এর ছবি পায়নি। তারা সোজা সাগরের গভীরে ডুবে গেছেন। যোগ দিয়েছেন সেসব হাজার হাজার মানুষের কঙ্কালের সঙ্গে, যারা আর কোনোদিন ইউরোপে যেতে পারবেন না। বিখ্যাত টাইটানিক ডুবে যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার এক-তৃতীয়াংশ হলো সর্বশেষ ডুবে মরা এই ৫০০ শরণার্থী। ওই ঘটনার সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে দেখবেন না। এটাও বলবেন না যে, এখনও এক মিলিয়ন মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়াকেই বেছে নিয়েছেন, আমরা গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যকার প্রণালী বন্ধ করে দিচ্ছি। না, যারা এই মেধাবী সংগীতশিল্পীর (প্রিন্স) মৃত্যুতে বিলাপ করছেন, সামাজিক মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন, তাদেরকে আমি রুষ্ঠ করতে চাই না। ‘পারপেল রেইন’-এর এই সুপারস্টারের ভক্ত রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। সেখানে আরবে যে ফেসবুক রয়েছে তাতে এই সুপারস্টারের মৃত্যুতে বেদনায় পূর্ণ। আমরা যদি আর একটু এগিয়ে যাই তাহলে বিস্মিত হতে হয়। যখন টেলিভিশনের উপস্থাপক-উপস্থাপিকারা মিনিয়াপোলিশের মেয়রের কাছে তাদের বেদনা প্রকাশ করছেন, আইফেল টাওয়ার রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, তখন অবশ্যই এমন একটি সময় এসেছে যখন আমরা নিজেদের কাছে প্রশ্ন করতে পারি, আমাদের অগ্রাধিকারের সব উদ্দেশ্য কি হারিয়ে যায়নি। কাবুলে যে তিনটি শিশু মারা গেছে তাদের কেউ একজনও কী একজন ‘প্রিন্স’ হয়ে উঠতে পারতো না? অথবা ভূমধ্যসাগরে যে ৫০০ মানুষ ডুবে মরেছেন তাদের মধ্য থেকে কোনো শিশু কী তা হতে পারতো না? একটি ছেলে বা একজন মেয়ে শিশু কী হতে পারতো না এক একজন সুপারস্টার? কতজন টিভি উপস্থাপক বা উপস্থাপিকা এসব শিশুর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন? অবশ্যই রক্তবর্ণের চেয়ে রঙটা হতে পারতো কালো। আইফেল টাওয়ারের আলো নিভিয়ে দেয়া হতে পারতো।কিন্তু তা হবে না। কারণ, এ সপ্তাহে ‘প্রিন্স’ মারা গেছেন।- মানবজমিন

২৫ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে