আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার রাজ্যের ৭০০০ ক্লাবকে প্রতি বছর দুলক্ষ টাকা করে অনুদান দেয়া শুরু করেছে।
এই খাতে যে শত শত কোটি টাকা খরচ হচ্ছে – বিরোধীরা তার সমালোচনায় সরব হলেও কিংবা আদালতে মামলা হলেও সরকার তাদের অবস্থানে অনড়।
আর শুধু পাড়ার ক্লাবেই নয়, অনুদান বা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল বিলিতে, অথবা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের দোকানেও।
এই ঢালাও দান-খয়রাতির রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে একটি নতুন প্রবণতা। কোষাগারের হাল শোচনীয় হলেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে এর প্রধান সমর্থক।
নির্বাচনের সময় এই সরকারি নীতি কি ক্ষমতাসীন দলকে বাড়তি কোনো সুবিধা দিচ্ছে? না কি বিরোধীরা যেমন দাবি করছেন এগুলো সম্পূর্ণ বাজে খরচ?
ভবানীপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী কেন্দ্রের একটি বক্সিং ক্লাবে বিকেলের অনুশীলন চলছিল। রাজ্যের প্রায় ৭০০০ ক্লাবের মধ্যে এটিও একটি, যারা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে প্রতি বছর দুলক্ষ টাকা করে অনুদান পাচ্ছে।
পাড়ার ক্লাব কেন সরকারের কাছ থেকে নগদ টাকা পাবে তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠলেও ভবানীপুর বক্সিং ক্লাবের সঞ্জয় প্রসাদ, সরোজ নন্দনরা কিন্তু মনে করছেন এটা দারুণ একটা উদ্যোগ।
সঞ্জয় প্রসাদ বলছিলেন, আর্থিক সমস্যায় ক্লাবগুলো এগোতে পারত না - এখন কিন্তু তার অনেক সুরাহা হয়েছে।
ক্লাবের কর্মকর্তা সরোজ নন্দন পাশ থেকে জানান, "এই টাকাটা পাওয়ায় বাচ্চাদের ট্রেনিং দেয়া যাচ্ছে ঠিকঠাক – কিটস জোগানো যাচ্ছে। আরো টাকা পেলে আরো ভাল হত।"
কিন্তু এটাও তো ঠিক রাজ্যের বহু ক্লাবে ছেলেপেলেরা সারাদিন বসে শুধু তাস পেটায়, আড্ডা মারে কিংবা ক্যারম খেলে। এই সব ক্লাবও কি সরকারি অর্থ পাওয়ার যোগ্য?
"দেখুন হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি সব ক্লাবও তো সমান নয়। হ্যাঁ, কিছু ক্লাব হয়তো অন্য দিকে খরচ করছে, কিন্তু আমাদের মতো অনেকেই কিন্তু ভাল কাজেই এই টাকাটার সদ্ব্যবহার করছে। এই যেমন আমরা দুবছর আগেই এই টাকা দিয়ে অল ইন্ডিয়া বক্সিং করলাম", জবাব দেন মি. প্রসাদ।
তবে ঘটনা হল, মমতা ব্যানার্জির সরকারের এই মর্জিমাফিক দান-খয়রাতি বিরোধীরা একেবারেই মানতে পারছেন না। প্রবীণ সিপিআইএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী তো সরাসরি বলছিলেন, এটা আসলে পাড়ায় পাড়ায় নিজেদের অনুগত ‘ক্যাডার’ তৈরি করার একটা কৌশল।
শ্যামল চক্রবর্তীর কথায়, "স্পোর্টস অ্যাকাডেমি বা ট্রেনিং ক্যাম্প হলে না-হয় বুঝতাম। এই টাকা দিয়ে ক্লাবগুলো তো দুর্গাপুজোর মণ্ডপ বা মসজিদের চাতাল বানাচ্ছে। কিংবা একটা রোয়াক যেখানে তারা আড্ডা মারতে পারবে। কিন্তু পাঁচ বছরে এই রাজ্য থেকে একটা ভাল ক্রীড়াবিদ বেরিয়েছে? একটাও না! কাজেই এই টাকাগুলো দিয়ে ক্লাবে ক্লাবে নিজেদের তাঁবেদার বাহিনী তৈরি করা ছাড়া কিছুই হচ্ছে না।"
বিরোধী দল কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেবব্রত বসুও মনে করেন সরকারি কোষাগারের অর্থ এভাবে বিলি করার এক্তিয়ার মুখ্যমন্ত্রীরও নেই।
তার যুক্তি, "কোষাগারের অর্থ রাজ্যের বিপদে-আপদে খরচ করা যায় – এভাবে ইচ্ছেমতো ক্লাবগুলোকে বিলি করা যায় না। ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকার দুলক্ষ কোটি টাকা ঋণ রেখে গিয়েছিল, আর তৃণমূল তো মাত্র পাঁচ বছরেই এক লক্ষ কোটি পার করে দিল। আমার যা রোজগার, খরচা তো তার চেয়ে অনেক বেশি।"
সরকারি কোষাগারের হাল যতই করুণ হোক, ধার করে হলেও মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু এন্তার দান-খয়রাতি চালিয়েই গেছেন। শুধু ক্লাবগুলোকে টাকাই নয়, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল বিলি করতে বা সরকারি হাসপাতালে বাজারের চেয়ে কম পয়সায় ওষুধ বেচতেও অর্থ খরচ হয়েছে দেদার।
তবে কলকাতার পিজি হাসপাতালে এমনই একটি ভর্তুকি দেয়া ফেয়ার প্রাইস শপে সুতপা লাহা বা সানাউল্লা হকের মতো ক্রেতারা দেখা হেল কম দামে ওষুধ পেয়ে ভীষণই খুশি।
গৃহবধূ সুতপা লাহা বলছিলেন, সরকারের ভীষণ ভাল উদ্যোগ এটা। বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে অনেক ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, মানুষের ভীষণ উপকার হচ্ছে। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো এগিয়ে এলে সরকার আরও অনেক ওষুধ কম দামে বেচতে পারবে বলে তার বিশ্বাস।
খিদিরপুরের সানাউল্লা হক আবার বললেন, ভর্তুকিতে দেওয়া ওষুধের মান নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে ঠিকই। কিন্তু এই কম পয়সায় পাওয়া ওষুধ নিয়ে তার অন্তত কোনও অভিযোগ নেই, তার ক্ষেত্রে এগুলো ভালই কাজ করেছে।
ভর্তুকি কোথায় দেওয়া হবে, কীভাবে হবে তা সরকার অবশ্যই ঠিক করতে পারে। কিন্তু একটা ক্লাবের অ্যাকাউন্টে অকারণে পয়সা দেওয়াটা অনৈতিক বলে মনে করেন কলকাতার ম্যানেজমেন্ট বিশারদ রামানুজ মজুমদারও।
অধ্যাপক মজুমদারের কথায়, "সরকার যদি বলে দিত এই টাকা দিয়ে তোমরা একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট, ম্যারাথন রেস বা ওই জাতীয় কিছু করবে সেটা বোঝা যায়। কিন্তু ওরকম কোনও ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্লাবগুলোকে দুলক্ষ টাকা করে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে – প্রকারান্তরে তারা ধরে নিয়েছে এটা আমাদের ফুর্তি করার জন্য সরকারের দেওয়া খরচ।"
এই কথাটাই আবার বলুন মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী কেন্দ্র ভবানীপুরের তৃণমূল কাউন্সিলর পাপিয়া সিংয়ের কাছে – তিনি ও তার সঙ্গীরা কিছুতেই মানবেন না পাড়ার ক্লাবে সরকারি দান-খয়রাতিতে কোনও ভুল হয়েছে বলে।
পাপিয়া সিং বলছেন, "ক্লাবের ছেলেরা ঠিকমতো টাকাপয়সা জোগাড় করতে না-পেরে অনেক ভাল ভাল কাজ এতদিন করতে পারত না। এখন যদি সরকার থেকে আমরা তাদের সাহায্য করি, বাচ্চাদের তাতে সাহায্য হয় তাতে আপত্তিটা কোথায়?"
পাশ থেকে অন্য তৃণমূল নেতারা যোগ করেন, "এই টাকাটা সিপিএম আমলেও পেত – কিন্তু মাত্র দুয়েকটা ক্লাব পেত, বাকিটা কোথায় হারিয়ে যেত কোনও হিসেব থাকত না। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি ন্যায্যভাবে সব ক্লাবকে পয়সা দিচ্ছেন – চারদিকে ক্লাবগুলো ভাল ভাল কত অনুষ্ঠান করতে পারছে।"
ক্লাবে টাকা-পয়সা দেওয়াটা ঠিক কি ভুল তা নিয়ে তর্ক চলছে একদিকে, অন্যদিকে পাড়ায় পাড়ায় সরকারের সমর্থক এক বিশাল যুবক বাহিনী যে নি:শব্দে তৈরি হয়ে গেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বিরোধীরা যা বলছেন বলুন, এবারের নির্বাচনী মরশুমে ক্লাবের এই ছেলেপিলেরাই মমতা ব্যানার্জির বড় ভরসা।-বিবিসি
২৫ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই