আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার পেছনে রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের সমর্থন একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়।
তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাদেরও একটা বড় অংশ ভরসা রেখেছিলেন তৃণমূলের ওপর।
কিন্তু গত পাঁচ বছরে মমতা ব্যানার্জির সরকার মুসলিমদের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটা পূর্ণ করতে পেরেছে? তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা কি আদৌ পাল্টেছে?
মুসলিমরা কি আরো একবার তার ওপর আস্থা রাখবেন – না কি তারা ঝুঁকবেন কংগ্রেস বা বামপন্থীদের দিকে? পশ্চিমবঙ্গের নানা এলাকায় ঘুরে চেষ্টা করা হয়েছে সে প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজর।
হুগলী জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে একটি মাদ্রাসার চত্বরে হাজারখানেক লোকের সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন ত্বহা সিদ্দিকি। রাজ্যে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় তীর্থক্ষেত্র ফুরফুরা শরিফের হুজুর তিনি – গোটা অঞ্চলে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি অকল্পনীয়।
জনসভায় দুই তরুণ কোরান হাফেজকে পাগড়ী পরাতে এসেছিলেন তিনি, কিন্তু ভোটের প্রসঙ্গ বাদ যায় কীভাবে? অতএব সিদ্দিকি সাহেব ঘোষণা করলেন, ‘দলের রং দেখে নয়, ভোট দেবেন কাজ দেখে। যে নেতারা মুসলিমদের সঙ্গে বেইমানি করেছে, মুসলিমদের কাজ করতে যাদের কষ্ট হয় – বুথের ভেতর বস্তার আড়ালে গিয়ে তাদের আচ্ছা করে লাথি কষাবেন!’
ত্বহা সিদ্দিকি নিজেই গর্ব করে বলেন, রাজ্যে মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতায় এনেছেন তিনি, তার মুখের কথায় প্রায় গোটা পঞ্চাশেক আসনে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয়।
কিন্তু পাঁচ বছর আগের মতো ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা এবারেও কি মমতা ব্যানার্জিকেই ঢালাও সমর্থন দিচ্ছেন?
এবারে কিছুটা সাবধানী সুরে তিনি বলেন, ‘পঁয়ত্রিশ বছরের ভুখা পাঁচ বছরে মেটানো কঠিন। আর ক্ষমতায় আসার মাত্র কয়েক মাসের ভেতর কলকাতায় রেড রোডের ঈদের নামাজে মুখ্যমন্ত্রী যেদিন ঘোষণা করলেন সংখ্যালঘুদের ৯৯% কাজ তিনি করে ফেলেছেন, সে দিন থেকেই কিন্তু তার ওপর মুসলিমদের বিশ্বাস নড়ে গেছে। তবু তার পরও উন্নয়ন তিনি একেবারে করেননি বললে বেইমানি হবে।’
তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেও তাকে এভাবে এখন মোটামুটি দুদিক সামলে কথা বলতে হচ্ছে, কারণ গত পাঁচ বছরে রাজ্যের মুসলিমদের বহু আশাভঙ্গের যন্ত্রণাও আছে। মানবাধিকার কর্মী শেখ আবদুল সেলিম যেমন বলছিলেন মুসলিম ছেলেমেয়েদের চাকরি বা কর্মসংস্থান এখনো অলীক স্বপ্ন হয়েই রয়ে গিয়েছে।
‘এখন কিন্তু মুসলিমরা পড়াশুনোয় ততটা পিছিয়ে নেই, প্রচুর মেধাবী মুসলিম ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরোচ্ছে – কিন্তু চাকরি নেই! যে সামান্য কয়েকটা চাকরি হচ্ছে তার সবই হচ্ছে পয়সা দিয়ে’, বলছিলেন তিনি।
অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্টের সাম্প্রতিক রিপোর্টও বলেছে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়েছে। সিপিএমের তরুণ এমপি ঋতব্রত ব্যানার্জিও প্রশ্ন তুলছেন, রাজ্যে কোনো চাকরিই হয়নি – তো মুসলিমরা কোত্থেকে চাকরি পাবেন?
ঋতব্রত বলছিলেন, ‘উনি বলছেন সত্তর লক্ষ চাকরি দিয়েছেন, আমরা বলছি একটাও হয়নি। একটাও কারখানা উনি দেখাতে পারবেন না যেখানে একশোটা লোকও চাকরি পেয়েছে। মুসলিমরা তো আর এই সমাজের বাইরে নন, ফলে স্বাভাবিকভাবে তাদেরও কিছুই জোটেনি।’
ডোমজুড়ের কাছে মুসলিম-অধ্যুষিত একটি গ্রামের চায়ের দোকানে সরকারের কাজের খতিয়ান তুলতেই অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া এল।
মেখপাড়ার হাজি রহমত আলি মনে করেন, ভালমন্দ মিশিয়েই কাজ করেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। শান্তিও মোটামুটি বজায় ছিল, আর তার জানাশোনা কিছু মুসলিম ছেলে কর্পোরেশনে চাকরিও পেয়েছে।
পাশ থেকে চায়ের দোকানদার হাসান যোগ করেন, ‘যেমন চলছে সব কিছু, আমরাও ওভাবেই চলছি। কী আর বলব বলুন তো?’
এদিকে মমতা ব্যানার্জির সরকার মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য মাসে দেড়-দুহাজার টাকা ভাতারও ব্যবস্থা করেছেন। তবে কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্র অবশ্য বলছিলেন, এতে ধর্মকে উৎসাহ দেওয়া হলেও সার্বিকভাবে মুসলিম সমাজের কোনও উপকার হয়নি।
‘সব প্রকল্পগুলোই দেখবেন ধর্মের জন্য, কিন্তু মুসলিম সমাজের আর্থিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্যগত উন্নয়নের জন্য কোনও উদ্যোগ নেই। অথচ সংবিধান কিন্তু সরকারকে এই সব উন্নয়ন খাতেই খরচ করার অনুমতি দেয়, অন্য কোথাও নয়’, বলছিলেন ড: মিশ্র।
মালদা, মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম-প্রধান জেলাগুলোতে যে তৃণমূল এখনও সুবিধে করতে পারেনি, সে কথাও উল্লেখ করছেন তিনি। তবে কাজ যতটুকুই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কবি সুবোধ সরকার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাজ্যের মুসলিমদের গায়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার আঁচ যিনি লাগতে দেননি – তার নাম মমতা ব্যানার্জি।
‘সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক কথাটা খুব চালু – আমার ধারণা অন্য সব রাজনীতিকের মতো মমতা ব্যানার্জির মাথাতেও সেটা আছে। কিন্তু তার পরেও যেটা অস্বীকার করার উপায় নেই তা হল ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির ক্ষমতায় আসার পর যে অসহিষ্ণুতার হাওয়া পশ্চিমবঙ্গকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল – তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মমতা একাই। এ রাজ্যে তিনি সেটা ঢুকতে দেননি’, বলছিলেন সুবোধ সরকার।
‘মাথায় হিজাবের মতো কাপড় দেওয়াটা তার হয়তো একটা বাহ্যিক ব্যাপার, কিন্তু খুব কাছ থেকে তাকে দেখেই বলছি সংখ্যালঘুদের ভেতর থেকে অন্তর দিয়ে ভাল না বাসলে এ জিনিস করা যায় না’, আরও যোগ করেন তিনি।
হিন্দুত্ববাদী দল বলে পরিচিত বিজেপির নেতা চন্দ্র বোস আবার বলছিলেন, এ রাজ্যে মুসলিমদের নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।
তার বক্তব্য, ‘পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিম-শিখ একত্রে বাস করলেও মমতা ব্যানার্জির রাজনীতি মুসলিমদের আলাদা করে দিয়েছে। সমাজের পিছিয়ে থাকাদের সুবিধে দেওয়ায় কোনও অন্যায় নেই – কিন্তু তিনি যেভাবে মুসলিমদের নিয়ে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করেছেন বা তাদের এমন সব সুবিধা দিযেছেন তাতে সমাজে বিচ্ছিন্নতা আর সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিই প্রশ্রয় পেয়েছে।’
এই সব দাবি ও পাল্টা দাবি, ভোটব্যাঙ্কের তকমা, চাকরির আশা আর ধর্মগুরুর নির্বাচনী উপদেশেই আজও হাঁসফাঁস করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ।
পাঁচ বছর আগে তারা হয়তো শাসকের রং বদলাতে পেরেছিলেন, কিন্তু তাদের নিজেদের রং যেমন বিবর্ণ ছিল আজও প্রায় তেমনই রয়ে গিয়েছে।-বিবিসি
২৭ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই