নিউজ ডেস্ক : বয়স তখন চার বছর, মা আর তাকে ফেলে অন্য একটি বিয়ে করে চলে যায় বাবা। যাওয়ার আগে তার মাকে অভিশাপ দিয়ে বাবা বলেছিলেন ‘তোমার ছেলে বড় হয়ে চোর হবে’। বাবার অভিশাপ যে তার গায়ে এতটুকু লাগেনি ১৩ বছর পর উচ্চমাধ্যমিকে ৪৬৭ পেয়ে প্রমাণ করে দিল চয়ন বিশ্বাস।
বাবা নিরুদ্দেশ, মা বাড়িতে বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে, ঘরে এতটাই অভাব যে দুবেলা দু মুঠো ভর পেট ভাতও জোটে না তার কপালে। দার্জিলিং জেলায় ছেলেদের মধ্যে সম্ভাব্য প্রথম হয়ে চয়ন বুঝিয়ে দিল অভাবের সঙ্গে লড়াই সে করতে পারে কিন্তু তার লক্ষ্য মেধাবী এবং ভালো মানুষ হয়ে মায়ের পাশে দাড়ানো। অভাব অন্তত তাকে চোর বানাবে না।
শিলিগুড়ি নেতাজি বয়েজ হাই স্কুলের ছাত্র চয়নের উচ্চ মাধ্যমিকে এত বড় সাফল্যতে স্বভাবতই খুশি তার স্কুলের সমস্ত শিক্ষকরা। নিজের এই সাফল্যের জন্য যে স্কুলের শিক্ষকদের অবদানও কম নয় তা জানাতেও ভুলল না চয়ন। কারণ স্কুলের শিক্ষকরাই তো তাকে পড়াশোনার জন্য বই কিনে দিত। আবার বিনা মূল্যে প্রাইভেট টিউশনও পড়াতেন। শুধু তাই নয় ঘরে অভাবের কারণে মাঝে মধ্যেই আধপেটা হয়ে স্কুলে আসতে হত তাকে। তাই দাদ্বশ শ্রেণীতে পড়লেও প্রায় স্কুলের মিড ডে মিল থেকে শিক্ষকরা তাকে খেতে দিতেন।
চয়ন জানিয়েছে তার বাংলায় প্রাপ্ত নম্বর ৯০, ইংরেজিতে ৯২,ভূগোলে ৮৭,ইতিহাসে ৯২,দর্শনে ৯৯, রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ৯৪। স্নাতকস্তরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নয় তো ইতিহাস নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে চয়নের। তার ইচ্ছে ছিল স্নাতকস্তরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করার। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা নেই সেখানে পড়ার।
তাছাড়া মাকে একা ফেলে যেতেও ইচ্ছে করে না চয়নের। তাই হয়তো শিলিগুড়ি কলেজেই পড়বে চয়ন। এমনই জানালো সে। চয়ন জানায় মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে মাসে মাত্র চার হাজার টাকা পান তা দিয়ে পড়াশোনার খরচ, সংসার খরচ, সঙ্গে বাড়ি ভাড়া গুনতে হয় মাকে। তাই মাকে সাহায্য করতে মাধ্যমিকের আগের থেকেই টিউশন করত চয়ন। তা সও্বেও মাধ্যমিকে ষ্টার পেয়েছিল সে। উচ্চমাধ্যমিকের আগেও নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি চালিয়ে গিয়েছিল চয়ন।
চয়ন জানাল রোজ ভোরে উঠে সে নিজের পড়া পড়ত। তারপর সকাল ৭ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত টিউশনি করত। তারপর স্কুলে আসতো। স্কুল থেকে গিয়ে আবার টিউশনি। তারপর রাতে আবার নিজের পড়া নিয়ে বসত।
চয়নের মা রিনা বিশ্বাস জানালেন ছেলে তাকে সাহায্য করতে শুধু টিউশনিই করত না, বাড়ির সমস্ত কাজও ছেলেই করত। কারণ তাকে সকাল সকাল কাজে বেড়িয়ে যেতে হত। ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যেত। তাই বাড়িতে রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, এইসব চয়নই সামলাতো। আর যেদিন রান্না করতে পারত না সেদিন না খেয়েই স্কুলে চলে আসত। দুপুরে পেট ভরে মিড ডে মিলের খাওয়া খেত।
রিনা দেবি জানালেন, অনেক সময় হয়েছে ঘরে চাল ফুরিয়ে গিয়েছে, আনাজও ফুরিয়ে গিয়েছে হাতে পয়সাও নেই, সেইসময় ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য যেসব বাড়িতে কাজ করেন তাদের থেকে শুকনো রুটি মুড়ি কখনো আবার ভাতের ফ্যান চেয়ে এনে ছেলেকে খাইয়েছেন। মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক কোন পরীক্ষার আগেই ছেলের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দিতে পারেন নি।
রিনা দেবি জানালেন, তাকে আর ছেলেকে ফেলে ১৩ বছর আগে তার স্বামী ঝন্টু বিশ্বাস অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে যান। ছেলের জন্মের পর থেকেই মা হিসেবে তিনি ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন বলে তার স্বামী চয়নকে অভিশাপ দিয়ে বলতেন ছেলে নাকি চোর হবে। তিনি চলে গেলে মা রিনা দেবি নাকি ছেলেকে একা মোটেও মানুষ করতে পারবেন না এমনই ধারণা ছিল তার বাবার।
এদিন তাই রিনা দেবী বললেন আজ খুব ওর বাবাকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে দেখে যাও ছেলে চোর হয়েছে, নাকি মায়ের ইচ্ছে মতই পড়াশোনায় মেধাবী হয়েছে। তিনি জানান ছেলেকে অনেক অভাবের মধ্যে দিয়ে মানুষ করেছেন। ছেলের সাফল্যতে তার আজ মনে হচ্ছে বাবাকে নিরবেই মোক্ষম জবাব দিল ছেলে।
ভবিষ্যতে চয়নের ইচ্ছা বি.ডি.ও কিংবা এস.ডি.ও হওয়ার। তার আগে অবশ্য স্নাতকে ভাল ফল করাটাও তার লক্ষ্য। কিন্তু স্নাতকে পড়াশোনার জন্য তাকে যদি কেউ আর্থিক সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এমনটা হলে খুবই খুশি হবে চয়ন।
১৮ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম