আন্তর্জাতিক ডেস্ক :নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়- পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সর্বপ্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের বিহারের পাটনা থেকে ৮৮ কিমি. দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গড়ে তোলা একটি প্রতিষ্ঠান যা ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ খ্রিস্টীয় শতাব্দীর মধ্যে তৈরি করা হয় এবং এটি ১১৯৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার সঠিক সময়কাল নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হল একরাদ্বাতীয়া সময়কালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধারণা করা হয় বৌদ্ধরাজা কুমারগুপ্ত ১ বা কুমারগুপ্ত ২-এর শাসনকাল হচ্ছে একরাদ্বিতীয়া।
কথিত আছে, বিখ্যাত মৌর্য সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে নালন্দাতে প্রথম বৌদ্ধ উপাসনালয় গড়েন যা পরে বৌদ্ধ গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকই একমত যে রাজা কুমারগুপ্তের সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা মগধে ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা প্রতিষ্ঠিত হয়। নালন্দা মূলত বৌদ্ধধর্মের গবেষণা ও ধর্মচর্চার জন্য নির্মিত হলেও সেখানে হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অনেক বিষয় পড়ানো হতো।
এ বিদ্যালয়ে বিদ্যার্জনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে বহু শিক্ষার্থীর সমাগম হতো। এ বিশ্ববিদ্যালয় এতই জনপ্রিয় ছিল যে, এখানে বিদ্যার্জন করতে সে সময়ে তিব্বত, চীন, কোরিয়া, গ্রিস, পার্সিয়া, তুরস্ক থেকে শিক্ষার্থী আসত। কিন্তু মানব সভ্যতা যেমন উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছতে পারে আবার তেমনি অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে জানে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এত বড় জ্ঞানপীঠকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। তাও একবার নয়, তিন বার।
বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে নালন্দা। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.) প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধবিদ্বেষী মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। তারা নির্মমভাবে বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধররা নালন্দাকে পুনর্গঠন করেন।
প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার এটি ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। মুর্শিদাবাদের শাসক শশাঙ্ক রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাস বিরোধে লিপ্ত হন। যার ফলে রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করেন। বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে খণ্ডবিখণ্ড করেন।
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের বর্ণনায় শশাঙ্কের আক্রমণ ও নালন্দা ধ্বংসের ইতিহাস ফুটে উঠেছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয়বারের মতো ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজি দ্বারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনো দলিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। বখতিয়ার খিলজির বিহার অভিযান ইতিহাসে কেবল ঐতিহাসিক মিনহাজের ‘তাব্বাকাত-ই-নাসিরি’ বইতেই লিপিবদ্ধ রয়েছে।
তবে নালন্দা পুরোপুরি ধ্বংস করা হয় বলে যে দাবি করা হয় তা কিন্তু সঠিক নয়। আসলে নালন্দার একটি বড় অংশকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। মূলত ১৫শ’ শতকের দিকে এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
হিন্দু, ব্রাহ্মণ ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজাদের নির্মম অত্যাচারের ফলে ভারতবর্ষের বৌদ্ধরা ব্যাপক হারে দেশত্যাগ করে। বলা হয়ে থাকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকোষাধার। শেষবারের মতো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে দেয়ার পর এর গ্রন্থাগারে যত বই সংরক্ষিত ছিল তা প্রায় তিন মাসব্যাপী পুড়েছিল।
২০০৬ সালে চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুরের সহায়তায় মাটিতে চাপা পড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। নালন্দাকে উদ্ধারের পর এর ব্যাপ্তি, ভবনগুলোর কাঠামো ও স্থাপত্যশিল্প দেখে পুরো বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়।
ভবনগুলোর কক্ষ ও সুযোগ-সুবিধা বিচার করে দেখা যায়, এত প্রাচীন একটি বিদ্যাপীঠে ১০ হাজার শিক্ষার্থী ও ২ হাজার শিক্ষকের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা ছিল। স্থাপত্যশৈলীতেও এটি একটি অনবদ্য নিদর্শন। উঁচু ও পুরু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল নালন্দা যা তার নিরাপত্তা ও শৃংখলা বিষয়টি গর্ব করে জানান দেয়।
মূল ভবনে মোট আলাদাভাবে ৮টি কম্পাউন্ড ও ১০টি মন্দির ছিল। সঙ্গে ছিল ধ্যান কক্ষ ও অনেক পাঠদান কক্ষ। প্রতিটি ভবনের সামনে ছিল জলাধার ও চিত্তাকর্ষক উদ্যান। বৌদ্ধ শাসনামলেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছিল।
সম্রাট হর্ষবর্দ্ধনের শাসনকালে আশপাশের গ্রামসহ মোট ২০০টি গ্রাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুদান হিসেবে দেয়া হয়। প্রায় ১৪ হেক্টর ভূমি নিয়ে গড়ে ওঠা লাল ইটের ভবনের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আজও সে সময়ের উচ্চতর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস জানান দিচ্ছে। ৮০০ বছর পর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আবারও চালু করা হয়েছে। -যুগান্তর
১২জুন২০১৬/এমটিনিজ২৪.কম/আরিফ/এমএম