আন্তর্জাতিক ডেস্ক : হরিয়ানভি ভাষায় লাডো মানে মেয়ে, কন্যাসন্তান। হরিয়ানার জিন্দ জেলা সদর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে বাসরাস্তার পাশেই যে ঢালু রাস্তা বিবিপুর গাঁয়ের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার নতুন নাম এখন লাডো মার্গ।
গ্রামের মধ্যেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাডো ঝিল, লাডো পার্ক কিংবা লাডো শক্তিস্থল। সমাজে মেয়েদের শোষণের বিরুদ্ধে এগুলোই বিবিপুরের নিজস্ব প্রতিবাদ।
প্রতিবাদ, কারণ ভারতের হরিয়ানায় মহিলা ও পুরুষের লিঙ্গ অনুপাত সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ – প্রতি হাজার পুরুষে ওই রাজ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ৮৭৯।
মহিলাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী বা কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো অপরাধকেই হরিয়ানায় এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে।
কিন্তু এই হরিয়ানারই একটি ছোট্ট গ্রাম বিবিপুরে মেয়েদের সসম্মানে সমাজে ঠাঁই দিতে চলছে নানা অভিনব পরীক্ষানিরীক্ষা।
মেয়ের সঙ্গে সেলফি তুলে বাবাদের তা পোস্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল এই বিবিপুরেই, এখন ওই গ্রামে সব বাড়ির নেমপ্লেটও বসানো শুরু হয়েছে বাড়ির মেয়েদের নামে।
কিন্তু এগুলো কি নেহাতই প্রতীকি, না কি বিবিপুর মডেল সত্যিই কন্যাসন্তানের প্রতি হরিয়ানার মনোভাব বদলাতে পারছে?
স্কুল ছুটির পর একসাথে বাড়ি ফিরতে থাকা মেয়েরা কিন্তু সমস্বরে বলে ওঠে, এই গ্রামে অন্তত ছেলেদের সঙ্গে তাদের আলাদা চোখে দেখা হয় না।
ইচ্ছেমতো তারা যেখানে খুশি ঘুরতে পারে, পরিবারে অনেক ব্যাপারে তাদের মত নেওয়া হয়। বাবারাও মেয়েদের খুব ভালবাসেন।
বিবিপুরে মেয়েদের বাবারা সারা দেশেই হঠাৎ করে বিখ্যাত হয়ে গেছেন – কারণ মেয়েদের সঙ্গে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার যে ট্রেন্ড ইদানীং খুব জনপ্রিয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত যাতে উৎসাহ দিচ্ছেন – তার সূত্রপাত এই বিবিপুরেই।
ভাবনাটা প্রথম এসেছিল বিবিপুর গ্রামের মুখিয়া বা সরপঞ্চ সুনীল জাগলানের মাথাতেই।
তিনি বলছিলেন, ‘দেশের যুবসমাজ থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, সবাই তো সেলফি বলতে পাগল। তো আমি ভাবলাম, কন্যাভ্রূণ হত্যা রোধে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই সেলফিকেই একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি না কেন?’
‘তো বিশ্বাস করবেন না, সেলফি উইথ ডটার প্রতিযোগিতা শুরু করার দুসপ্তাহের মধ্যে আমার হোয়াটসঅ্যাপে গোটা হরিয়ানা থেকে দুহাজার ছবি এসে হাজির। আর প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে টুইট করার পর তো কথাই নেই’, সগর্বে বলেন বিবিপুরের সরপঞ্চ।
বিবিপুরের গ্রাম পঞ্চায়েত এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে পরিবারের কর্তাদের বোঝাচ্ছেন, বাড়ির নেমপ্লেট বদলে পরিবারের স্ত্রী বা কন্যার নামে ফলক রাখুন।
সুনীল জাগলান অবশ্য স্বীকার করছেন এতে খানিকটা প্রতিরোধ আসছে, মেয়েরা পরে সম্পত্তি দাবি করে বসবে কি না এই ভয়টা কারও কারও মধ্যে কাজ করছে।
তবে এটা ঠিকই, বিবিপুরের সাত থেকে সত্তর – সব রকম বয়সী মেয়েরাই এটা বুঝছেন, গ্রামে তাদের কদর বেড়েছে।
এক প্রবীণা যেমন বলছিলেন, ‘এতদিনে আমাদের গেট খুলেছে, জমানা এসেছে – সারা জীবন তো কেউ আমাদের দিকে ঘুরেও দেখেনি। আমার দুটো নাতনি, আমি তো ওদের নামেই বাড়ির নেমপ্লেট বসিয়েছি।’
এই সব পরীক্ষানিরীক্ষা ভালই কাজে দিচ্ছে, সমাজের মনোভাবও সত্যিই বদলাচ্ছে, বলছিলেন গ্রাম পঞ্চায়েতের বর্ষীয়ান সদস্য জয়ভগবান লাল। গ্রামের অশ্বত্থতলার চৌপলে বসে তিনি জানালেন গত বছর এই গ্রামে ৫৩টি মেয়ে আর ৪১টি ছেলে জন্মেছে।
‘কাজেই বুঝতেই পারছেন, লিঙ্গ অনুপাত শোধরাচ্ছে। লোকে এখানে ছেলে জন্মালে হিজড়ে ডেকে নাচাগানা করায় – আমি কিন্তু নাতনি হওয়ার পরও হিজড়ে ডেকে হইচই করেছি, পার্টি হয়েছে!’ সগর্বে বলেন জয়ভগবানজি।
তবে গ্রামের কোনও কোনও যুবক আবার মনে করছেন, এগুলো সবই লোকদেখানো ব্যাপার – আসল কাজের চেয়ে প্রচারটাই বেশি হচ্ছে।
বাসরাস্তার মোড়ে আমাকে তারা বোঝাতে থাকেন, ‘লাডো মার্গ নাম রাখলেই কি কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধ হবে না কি? যা হচ্ছে সব কাগজে-কলমে, আর সরপঞ্চ শুধু নিজের প্রচার চাইছেন।’
পাশ থেকে একজন আবার যোগ করেন, ‘এখন গ্রামে কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধ হয়েছে এটা বলে আসলে বিবিপুরকেই অপমান করা হয়েছে – যেন আগে সত্যিই এখানে ভ্রূণহত্যা হত!’
ফলে বিবিপুর মডেল কতটা কার্যকরী, তা নিয়ে বিতর্ক আছেই।
রাজনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক যোগেন্দ্র যাদব হরিয়ানার মনস্তত্ত্বটা খুব ভাল বোঝেন, তিনি অবশ্য মনে করেন এই প্রতীকি উদ্যোগও একেবারে ফেলনা নয়।
যাদবের কথায়, ‘এই সিম্বলিজম কতদূর যেতে পারে, তার কিন্তু একটা সীমা আছে। সেলফি বা মেয়েদের নামে নেমপ্লেট ভাল জিনিস, কিন্তু এটা তখনই আরও সফল হবে যখন আরও দুটো জিনিস – পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার নিশ্চিত করা যাবে আর পণপ্রথা বন্ধ করা যাবে।’
‘পারিবারিক আইন মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দিলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই – আর প্রধানত পণের কারণেই কিন্তু কন্যাসন্তান অবাঞ্ছিত। কাজেই এই প্রতীকগুলো শেষ পর্যন্ত এতদূর আসতে পারে কি না, সেটাই আমাদের দেখতে হবে’, অভিমত যাদবের।
আপাতত বাবার সাথে সেলফি আর বাড়ির সামনে জ্বলজ্বলে নামফলক নিয়েই কিন্তু বিবিপুর স্বপ্ন দেখছে – গোটা হরিয়ানায় তারা একটা নি:শব্দ বিপ্লব এনে দিতে পারবে।
পরের আদমশুমারিতে হয়তো অল্প হলেও বাড়বে মেয়েদের আনুপাতিক সংখ্যা! -বিবিসি
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি