আন্তর্জাতিক ডেস্ক :ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষেই ঐতিহাসিক গণভোটে রায় দিয়েছেন বৃটিশ জনগণ। এ মুহূর্তে পাঁচটি প্রশ্নের মুখোমুখি বৃটেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণে তুলে ধরা হয়েছে তা। গণভোট ফলের প্রভাব কী?
ইইউ এখন রীতিমতো বিধ্বস্ত। সংস্থাটির কোনো সদস্য রাষ্ট্রই এর আগে কখনও ইইউ ত্যাগ করেনি। তবে ইইউ চুক্তির ৫০ অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা আছে কীভাবে একটি রাষ্ট্র এই জোট ত্যাগ করতে পারে, সেখানে তেমন বিস্তারিত কিছু নেই। আগামী দুই বছর ধরে বৃটেনের ইইউ ত্যাগের আইনি প্রক্রিয়া চলবে।
অনেকের শঙ্কা, এ প্রক্রিয়া খুব দ্রুতই তিক্ত হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, গণভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ইইউ নেতাদের সঙ্গে ক্যামেরন একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন। সেখানে অভিবাসন রোধ, ইউরো-জোন থেকে লন্ডনের আর্থিক স্বার্থ সুরক্ষা ও বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ ছিল। কিন্তু গণভোটের দরুন এ চুক্তির কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।
কোনো ত্যাগ-চুক্তি সম্পন্ন না হলে, ইইউ আইন অনুযায়ী ছেড়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক নোটিস দেয়ার পর এটি কার্যকরের জন্য দুই বছর সময় প্রয়োজন হবে। ইইউ-ত্যাগ চুক্তি সমপন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বৃটেন ইইউর পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রই থাকবে।
তবে ইইউ-ত্যাগ সম্পর্কিত বিভিন্ন শর্তে বৃটেনের অন্তর্ভুক্তি থাকবে না। আর চুক্তি সম্পন্নের জন্য বৃটেন ও ইইউ’র ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের বেশিরভাগের সম্মতি প্রয়োজন হবে। তবে অনেকের ধারণা, বাস্তবে ইইউর অনেক বিষয়ে এখন বৃটেনের অন্তর্ভুক্তি আগের মতো থাকবে না। ব্রেক্সিট ক্যাম্পেইনারদের অনেকে বলছেন, বৃটেনের উচিত এই বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত করা। যেমন, ইইউ বাজেটে অর্থায়ন বন্ধ ও ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে অভিবাসন বন্ধে এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এমনটি হলে ইইউ পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে।
এ মুহূর্তে কী ঘটছে?
ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক, যিনি আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন, তিনি গণভোটের পূর্বে সব ইইউ নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন।
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যঁ-ক্ল জাঙ্কার, যিনি কার্যত ইইউর প্রধান নির্বাহী, তার ব্রাসেলসের সদর দপ্তরে বৈঠক করেছেন টাস্ক ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন স্কালজ। সেখানে নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট্টে, যার সরকার আবর্তনশীল ইইউ প্রেসিডেন্সি ভোগ করছে, তিনিও উপস্থিত ছিলেন। এখন পর্যন্ত তিনটি বিষয়ের মাধ্যমেই ইইউর অবস্থান ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এক. হতাশা।
ইইউর পুরো অর্থনীতির এক-পঞ্চমাংশ হারিয়ে যাবে। আরো বেশি হারাবে সামরিক ও বৈশ্বিক প্রভাব। দুই. শ্রদ্ধা। বৃটিশ জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। তিন. সমাধান। বাকি ইইউকে এক রাখার দিকে নজর দেয়া হবে। এছাড়া বৃটেনকে ইইউ নেতারা মনে করিয়ে দেবেন, এখনও দেশটি ইইউর পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র। লুক্সেমবার্গে নিয়মিত বৈঠকে একত্রিত হচ্ছেন ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। জার্মান ও ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইইউ’র প্রতিষ্ঠাতা বাকি চার দেশ ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। পুরো জোটের মন্ত্রীরা গণভোটের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন।
ডোনাল্ড টাস্ক শিগগিরই শীর্ষ চার ইইউ রাজধানী রোম, প্যারিস ও বার্লিনে এ সপ্তাহান্তে উড়াল দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে আলোচনা করা হবে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। প্রতিষ্ঠাতা ছয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বার্লিনে শনিবার দেখা করতে পারেন। রোববার ইইউ প্রতিনিধিরা ব্রাসেলসে একত্রিত হবেন। জাঙ্কার ২৮ সদস্যবিশিষ্ট ইইউ কমিশনের বৈঠক আহ্বান করবেন রোববার। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া ওঁলাদ ও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল সোমবার বার্লিনে দেখা করবেন। ক্যামেরনের মিত্র ও ইইউতে বৃটেনের কমিশনার জোনাথন হিল, যিনি ইইউর ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মতো সংবেদনশীল দায়িত্বে ছিলেন, তার পদ কেড়ে নেয়া হতে পারে। তিনি বরং পদত্যাগ করতে পারেন। ফলে নতুন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এ পদে অন্য কাউকে নিয়োগ দেবেন, যদিও অল্প সময়ের জন্যই ওই ব্যক্তি এ পদে থাকবেন। এ সপ্তাহান্তে দেখা করতে পারেন ইউরো জোনের অধীনস্থ অর্থমন্ত্রীরা। মঙ্গলবার থেকে ইইউ নেতারা ব্রাসেলসে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে যোগ দেবেন। সেখানে ক্যামেরন গণভোট নিয়ে রিপোর্ট করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। জুলাই মাসে আবারও বৈঠকে বসতে পারেন নেতারা।
আর্টিকেল ৫০ কী?
লিজবন চুক্তি, যার মাধ্যমে ইইউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার ২৬১ শব্দের আর্টিকেল ৫০-এ একটি সদস্য রাষ্ট্রের ইইউ ত্যাগের ব্যাপারে বলা আছে। সেখানে বলা আছে, একটি সদস্য রাষ্ট্র, যেটি ইইউ ত্যাগ করতে চায়, তারা ইউরোপিয়ান কাউন্সিলকে উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করবে। ওই রাষ্ট্রের সঙ্গে ইইউ একটি চুক্তি নিয়ে আলাপ আলোচনা করবে। যাতে সদস্যপদ প্রত্যাহারের ব্যবস্থাও করা হবে। এছাড়া ইইউর সঙ্গে ভবিষ্যতে কী সম্পর্ক থাকবে, তারও রূপরেখা থাকবে চুক্তিতে।
ইইউর ভবিষ্যৎ কী?
বার্ষিক ১৪৫ বিলিয়ন ইউরো বাজেটের ৭ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দ্রুত পূরণ করতে হবে ইইউকে। পাশাপাশি বৃটেনের অবদানও হারাতে হচ্ছে। বাণিজ্য করার ব্যাপারে ইইউর বেঁধে দেয়া অধিকার ব্যবহার করা কোম্পানিগুলোর স্ট্যাটাস সম্পর্কে দ্রুতই বক্তব্য দেবে জোটটির কর্তৃপক্ষ। ইইউর মিনিস্টেরিয়াল কাউন্সিলে নিজেদের ছয় মাসের প্রেসিডেন্সি জলাঞ্জলি দেবে বৃটেন। এ জায়গা দখল করবে এস্তোনিয়া বা মাল্টা বা ক্রোয়েশিয়া। বৃটেনের গণভোটের ফল নিয়ে ইইউ-বিরোধিতার যে আঁচ মহাদেশজুড়ে লেগেছে, তা প্রতিরোধে ইইউ নেতারা হয়তো ঐক্যের নিদর্শন দেখাতে চাইবেন। আগামী এপ্রিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনমতে শীর্ষে থাকা প্রার্থী ম্যারিন লি পেনও ইইউ ছাড়ার কথা আকারে ইঙ্গিতে বলছেন। এদিকে জার্মানিতেও ২০১৭ সালে নির্বাচন হবে। বৃটেন ছাড়াই ইইউর ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা হয়তো আবারও পুনর্জ্জীবিত করা হবে। আগামী সম্মেলনের এজেন্ডাতেই থাকছে ইইউর বড় ধরনের নিরাপত্তা নীতি পর্যালোচনার বিষয়টি। আফ্রিকা থেকে অভিবাসনের স্রোত ঠেকানোর দিকেও দেয়া হবে মনোযোগ।
কী পরিবর্তন আসবে?
কাগজে কলমে কিছুই পরিবর্তন হবে না। বৃটিশরা এখনও ইইউ নাগরিকই থাকবে। ব্যবসা বাণিজ্য আগের মতোই চলবে। কিন্তু বাস্তবে, অনেকের ধারণা বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইইউ জোট ছেড়ে বৃটেনের চলে যাওয়ার ছাপ পড়বে। বৃটেনের চলে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ইইউতেও। আবার বৃটেনের মধ্যেই বিভাজন হতে পারে। স্কটল্যান্ড ইতিমধ্যে ইইউতে থাকার জন্য বৃটেন থেকে স্বাধীনতা দাবি করতে পারে।
এছাড়া নতুন একটি সমঝোতার কথাও বলা হচ্ছে। এখানে বৃটেনকে কিছু সুবিধা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। ইউরোপের মুক্ত অভিবাসন প্রথা ও ইইউ বাজেটে অর্থ দেয়া থেকে বৃটেনকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এসবই ব্রেক্সিট ভোটারদের ক্ষুব্ধ করার কারণ। এ ধরনেরই কিছু উদ্যোগ নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড ভিন্ন কায়দায় গ্রহণ করেছে। তাই সতর্ক কূটনীতিকরা কোনো আশ্চর্যজনক সম্ভাবনাকেও নাকচ করছেন না।-এম জমিন
২৫জুন২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এআর