নিজস্ব প্রতিবেদন : প্রশ্নটা ফের উঠে গেল। এবং এ বার জোরালো ভাবে। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম) নামে দেশজ জঙ্গি সংগঠনটাই কি কূলগোত্র পাল্টে ফেলে এখন ভারতে ইসলামিক স্টেট-এর শাখা হিসেবে কাজ করছে? যার ফলে দেশের একটার পর একটা শহরে তৈরি হচ্ছে আইএসের বিভিন্ন মডিউল বা গোষ্ঠী!
ইস্তাবুলের বিমানবন্দরে তখন পর পর বিস্ফোরণ ও গুলিবৃষ্টি করছে সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গিরা। তার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে প্রায় সেই সময়েই, মঙ্গলবার মাঝরাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত, ভারতের হায়দরাবাদের ১১টি জায়গায় অভিযান চালাল ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।
পাঁচ জন যুবককে আইএসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে, আটক করা হয়েছে আরও ছ’জনকে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র, নগদ ১৫ লক্ষ টাকা ও বিভিন্ন সরঞ্জাম। এনআইএ-র একটি সূত্রের খবর, সিরিয়ায় থাকা আইএসের সঙ্গে তাদের একাংশের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল মূলত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।
হায়দরাবাদ সিটি পুলিশের সহায়তায় এনআইএ-র ওই অভিযানে সাফল্য মেলার পরেই ভারতে আইএম থেকে আইএসে রূপান্তরের বিষয়টি ফের সামনে এনেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাদের একাংশ।
এনআইএ-র আইজি সঞ্জীব সিংহ জানিয়েছেন, ধৃত পাঁচ যুবকের বয়স ২৪ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে। তারা মোটামুটি শিক্ষিত। যেমনটা ছিল আইএমের সদস্যেরা। আবার ইউরিয়া, হাইড্রোজেন পারক্সাইডের মতো রাসায়নিকও উদ্ধার করা হয়েছে আটক যুবকদের কাছ থেকে। একটা সময়ে আইএম যখন নাশকতা ঘটাত, তখন তাদের আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরির অন্যতম উপাদান ছিল ইউরিয়া।
আইনজীবীদের টানা ধর্মঘটে হায়দরাবাদে এমনিতেই এখন অচলাবস্থা। এনআইএ সূত্রের খবর, এরই সুযোগ নিয়ে শহর জুড়ে হামলার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। শহরের বিশেষ কিছু ধর্মস্থান, শপিং মল তাদের নিশানায় ছিল। যে ভাবে নাশকতার ছক কষত ইয়াসিন ভটকল, তেহসিন আখতারের নেতৃত্বে আইএম জঙ্গিরা।
এনআইএ-র মুখপাত্র সঞ্জীব সিংহ জানান, ধৃত পাঁচ জনের নাম: মোহাম্মদ ইলিয়াস ইয়াজদানি ও তার বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহিম ইয়াজদানি, হাবিব মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ইরফান ওরফে ইয়াকায়িস ইরফান এবং আবদুল্লা বিন আহমেদ আল আমুদি ওরফে ফাহাদ। এদের মধ্যে ইয়াজদানি ভাইয়েরা পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন।
ধৃত ও আটক যুবকদের কাছ থেকে দু’টি পিস্তল, এয়ারগান ও তার গুলি, ২৩টি মোবাইল, তিনটি ল্যাপটপ, ট্যাব, পেনড্রাইভ, বন্দুকের নিশানা অনুশীলন করার বোর্ড, বিদেশি ছুরি, ঘড়ি, মুখোশ, দস্তানার মতো সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে।
এনআইএ-র এক কর্তা জানান, ধৃত পাঁচ জন বাদে আটক বাকি ছয় যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানার চেষ্টা হচ্ছে, তারা কতটা জড়িত।
আইএসের পক্ষ থেকে একাধিক বার ঘোষণা করা হয়েছে, খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোতে চাইলে ইরাক ও সিরিয়ায় এসেই যুদ্ধে সামিল হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। চাইলে নিজের দেশেও নাশকতা ঘটিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি করা যেতে পারে। কিংবা ছুরি দিয়ে এক জন শত্রুকে খুন করতে পারলেও উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মতে, ইরাক ও সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের যোদ্ধা হয়েছে, এমন ভারতীয়ের সংখ্যা হয়তো জনা চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়। কিন্তু তার বাইরে চুপিসাড়ে ভারতের বহু তরুণের মগজধোলাই মূলত সাইবার দুনিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে করছে আইএস, যাতে ওই যুবকেরা দেশে নাশকতা ঘটাতে পারে। গোয়েন্দাদের মতে, আইএসের পক্ষে ইরাক ও সিরিয়া থেকে ভারতে হামলা চালানো সম্ভব নয়, কিন্তু ভারতীয় যুবকদের মগজধোলাই করে তাদের দিয়েই ভারতে হামলা চালাতে চায় আইএস।
এ বছর জানুয়ারি মাসে দিল্লি, হায়দরাবাদ-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে অভিযান চালিয়ে ভারতে আইএসের শাখা সংগঠন, জুনুদ-অল-খলিফা-এ-হিন্দ-এর সদস্য সন্দেহে জনা বিশ যুবককে গ্রেফতার করেছিল এনআইএ। যারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নাশকতার ছক করছিল বলে গোয়েন্দাদের দাবি। আবার ধৃতদের মধ্যে কর্নাটক ও মুম্বাইয়ের দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হুগলির ধনেখালির বাসিন্দা, আশিক আহমেদের হদিস পায় এনআইএ। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, বর্ধমানের এক পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র আশিক পশ্চিমবঙ্গে নাশকতা ঘটানোর চেষ্টায় ছিল। এ বার হায়দারাবাদে যাদের গ্রেফতার ও আটক করা হল, তাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কারও যোগাযোগ রয়েছে কি না সেই খোঁজ শুরু হয়েছে।
এনআইএ-র এক কর্তার বক্তব্য, কলকাতার কাছে কৈখালির বাসিন্দা, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার মেহেদি মসরুর বিশ্বাসকে ২০১৪-র ডিসেম্বরে বেঙ্গালুরুতে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেখানে বসে আইএসের সব চেয়ে প্রভাবশালী ট্যুইটার হ্যান্ডল তৈরি ও সেটি চালানোর অভিযোগে।
ওই গোয়েন্দা অফিসার বলেন, ‘ভারতের ক্ষেত্রে বিপদটা এখন আর শুধু সাইবার দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ নেই। সাইবার দুনিয়ায় পেয়ে যে সব যুবকের মগজধোলাই আইএস করছে, তাদের অনেকেই ভারতে নাশকতা ঘটাতে তৈরি হচ্ছে। হায়দরাবাদে আমরা সেই প্রমাণই আবার পেলাম।’ -আনন্দবাজার
৩০ জুন ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস