রঞ্জন বসু : ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বাজবো বাজবো করছে। দিল্লির আকাশ কালো করে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে- আর জওহর ভবনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূল গেটটার সামনে বাবা-মার হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা সনু। এতদিন বাদে ছেলেটা কোলে ফিরে এলো- কিন্তু এই বৃষ্টি বন্ধ না-হলে বাড়িতে গিয়ে কি ঠিক সময়ে ইফতার খোলা যাবে? এত খুশির মধ্যেও মা মুমতাজ বেগমের কপালে একটু চিন্তার ভাঁজ।
একটু আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ নিজের চেম্বারে বাবা-মার সামনেই সনুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দেশে স্বাগত জানিয়েছেন। তারপর সনুকে জাপটে ধরে তোলা সেই ছবি নিজে টুইট করেছেন, লিখেছেন ‘ওয়েলকাম হোম সনু’। বাংলাদেশে যারা এতদিন ধরে ছোট্ট এক ভারতীয় অতিথিকে আগলে রেখেছিলেন মন্ত্রী তাদেরও ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি।
এর সবটাই যেন সনুর বাবা-মা মেহবুব আর মুমতাজের চোখে স্বপ্নের মতো লাগে – নিউ সীমাপুরীর নিম্নবিত্ত কলোনির ঘিঞ্জি গলি থেকে দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে এই রাজকীয় ক্ষমতার অলিন্দ, অজস্র মিডিয়ার ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানি – মাঝবয়সী এই দম্পতি যেন কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না। মুমতাজ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন হারিয়ে ফিরে পাওয়া ছেলেটাকে, ঘামে আরও সপসপ করে ওঠে সনুর লাল টি-শার্টটা।
সনুর বাবা মেহবুব বাংলায় তেমন সড়গড় না-হলেও মা মুমতাজ ঝরঝর করে বাংলা বলেন, তবে বহুদিন দিল্লি থাকার সুবাদে ফাঁকফোকরে হিন্দি শব্দও ঢুকে পড়ে। ছবছর বাংলাদেশে কাটিয়ে ফেরার পর সনু এখন হিন্দি প্রায় ভুলেই গেছে – বাংলাটাই শুধু আসে, তাতে মার এতটুকুও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু মেহবুব মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস না করে পারছেন না, ‘ক্যায়া হিন্দি ভুল গয়া ক্যায়া?’ জবাবে সনু শুধু হাসে।
মাসতিনেক আগে বাংলাদেশের এক সাধারণ নাগরিক, জামাল ইবনে মুসাও চিরকুটে লেখা সামান্য কিছু তথ্য নিয়ে সনুর বাবা-মাকে খুঁজে বের করার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। সেদিন জামাল ইবনে মুসার জেদ, দিল্লিতে স্থানীয় টিভি চ্যানেল আইবিএন সেভেন সাংবাদিকদের সাহায্যে ঠিকই খুঁজে বের করেছিল সীমাপুরীর কলোনি থেকে সনুর বাবা-মাকে। মুসা সেদিনও মেহবুব ও মুমতাজকে নিয়ে সাউথ ব্লকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে সনুকে ফিরিয়ে আনার আর্জি নিয়ে। আশ্বাস পেয়েছিলেন, ডিএনএ মিললে নিশ্চয় সনু ভারতে ফিরবে।
‘জামালভাই আসলে আমার কাছে খুদা ভি, ভগবান ভি! আমি তো ওপরওয়ালাকে দেখিনি, কিন্তু বিশ্বাস করুন তিনি আমার কাছে ওপরওয়ালার চেয়ে কিছুতেই কম নন। একটা মানুষ একটা অচেনা হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে তারা বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এতদূর করতে পারে, কেউ কখনও ভেবেছিল? জামালভাই মানুষটা ছিল বলেই আমার জীবনে আজ সবচেয়ে খুশির ঈদ! সনুই আমার এবারের ঈদের চাঁদ’ – প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁফাতে থাকেন মুমতাজ বেগম।
একটু বাদে বৃষ্টি যখন ধরল, সরকারি গাড়িতে চেপেই সনু বাবা-মার সঙ্গে মিলে বাড়ির দিকে রওনা দিল। জনপথের বৃষ্টিভেজা রাস্তায় স্টার্ট দিল এক গাড়িভর্তি খুশি। ছবছর বাদে দিল্লিতে পা রাখা সনু কোনও কথা বলছিল না- কিন্তু তার হাসিভরা মুখটাই সব বলে দিচ্ছিল।
তবে এত খুশির মধ্যেও সনুর এই রূপকথার মতো ফিরে আসাটা তারা মাঝবয়সী বাবা-মার জীবনে দাম্পত্য টানাপোড়েনের পুরনো একটা স্মৃতিকেও যে উসকে দিচ্ছে, সেটা কিন্তু গোপন থাকছে না। সাউথ ব্লকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সনুর মা মুমতাজকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা সনু হারিয়ে গেল কীভাবে সেটা একটু বলুন তো? জবাবে খুব নিচু স্বরে তিনি যা বললেন তা কিন্তু চমকে দেওয়ার মতোই!
আসলে বছরদশেক আগে মেহবুব-মুমতাজের সংসারে আবির্ভাব হয়েছিল রহিমা বেগমের। বাংলাদেশি বিধবা, কোলের একটা মেয়ে নিয়ে দিল্লি শহরে খুব অসহায় অবস্থায় পড়েছিলেন – খাওয়া পর্যন্ত জুটছিল না। ওর অবস্থা দেখে মুমতাজের দয়া হয়, বাড়ির একটা বাড়তি ঘরে তাদের আশ্রয় দেন তিনি। ‘বাঙালি তো, ফেলতে পারিনি জানেন – তবে আমি মোটেও বুঝিনি যে ওরা আসলে বাংলাদেশের লোক’, বলছিলেন মুমতাজ।
কিন্তু একই বাড়িতে থাকার সুবাদে মুমতাজের স্বামী মেহবুবের সঙ্গে গোপনে একটা সম্পর্ক তৈরি হয় আশ্রিতা রহিমা বেগমের। অন্তত মুমতাজের ভাষ্য সেরকমই। ‘যেদিন ওদের মধ্যেকার ব্যাপারটা আমার সামনে ধরা পড়ে গেল, সেদিন আর ধৈর্য ধরতে পারিনি। খুব গালমন্দ করে রহিমাকে সে দিনই বাড়ি থেকে বের করে দিই। মিথ্যে বলব না, একটু মারধরও করেছিলাম।’
সনু হারিয়ে যায় এর ঠিক সাত দিন বাদে। প্রথমে মুমতাজ নাকি বুঝতেই পারেননি, রহিমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সনুর হারিয়ে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে। পরে নানা পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে দুয়ে দুয়ে চার করেন তিনি – বাড়ি থেকে লাথিঝাঁটা দিয়ে বার করে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতেই মুমতাজের চোখের মণি সনুকে তুলে নিয়ে যান রহিমা। নিয়ে সোজা পাড়ি দেন সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে।
আজ এত কাণ্ডের পর সেই সনুকে ফিরে পেয়েছেন মুমতাজ – ওদিকে বাংলাদেশের আদালতে অপহরণের মামলা চলছে রহিমা বেগমের বিরুদ্ধে। রহিমা অবশ্য কোর্টে দাবি করেছেন, সনুকে তিনি অপহরণ করেননি – বরং সনুর বাবা মেহবুবই নাকি স্বেচ্ছায় তার ছেলেকে তুলে দিয়েছিলেন রহিমার হাতে। গোপনে মেহবুব তাকে নিকাহ করেছিলেন এবং প্রথম পক্ষের ছেলের অবিভাবক হিসেবেই রহিমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন– রহিমা নিজে এমন দাবি করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
কে সত্যি, কে মিথ্যে নাকি সকলের গল্পেই সত্যিমিথ্যে মিশে আছে কে বলতে পারে। কিন্তু সনু ফিরে আসার পর মেহবুব ও মুমতাজের দাম্পত্য জীবনের একটা অস্বস্তিকর অধ্যায় যে নতুন করে আজ আবার সামনে চলে এসেছে, শত চেষ্টাতেও তা স্বামী-স্ত্রীর কেউ লুকোতে পারেননি।
তাতে শুধু কিছু যায় আসে না ছোট্ট সনুর। অনেক অনেক দিন বাদে সে আজ নিজের মায়ের গলা আঁকড়ে ধরে শান্তির ঘুম ঘুমোবে। সীমাপুরীর কলোনিতে ঈদ যে এসে গেছে পুরো পাঁচদিন আগেই! -বাংলা ট্রিবিউন
০১ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম