বিনোদন ডেস্ক : আজ ১১ সেপ্টেম্বর বলিউড শাসক অমিতাভ বচ্চনের ৭৩তম জন্মদিন। এখনও থামার বয়স হয়নি তার। ছুটছেন সমান গতিতে। মাত করছেন সর্বস্তরে।
১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি ‘ভুবন সোম’ ছবিতে ভাষ্যকারের ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ এরপরেই ‘সাত হিন্দুস্তানি’ ছবিতে প্রথম স্ক্রিনে আসার সুযোগ৷ ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় বিখ্যাত ছবি ‘আনন্দ’৷ সেসময় বলিউডের সুপারস্টার রাজেশ খান্নার সঙ্গে প্রথম স্ক্রিন শেয়ার করা৷ এই ছবির পরে আর পিছনে তাকাতে হয়নি৷ ‘আনন্দ’ ছবিতে এক চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করে ছিনিয়ে নেন ফিল্মফেয়ার সেরা সাপোর্টিং অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড৷ অনেকে বলেন ‘আনন্দ’ ছবি থেকেই ধ্বংসের মুখে পড়েন রাজেশ খান্না আর তার একমাত্র কারণ নাকি ছয় ফুট লম্বা, রোগা এই মানুষটি! যিনি বলিউডের জীবন্ত শীর্ষ কিংবদন্তী অমিতাভ বচ্চন৷
পরদায় সানি শেখ রূপী আমজাদ খানকে ঘুষি মারছেন তিনি৷ আর একটা দশক তার সব রাগ-ঘেন্না-হতাশা নিয়ে শক্তি যোগাচ্ছে তাঁর বাহুতে৷ আসলে তিনি তো নিজের জন্য মারছেন না, মারছেন চুরি যাওয়া ‘মাসুম’ বাচ্চাটির জন্য৷ মারছেন অন্ধকার দুনিয়ার ছোয়াঁয় তাঁর শেষ হয়ে যাওয়া ‘ইনসানিয়াত’-এর বদলা নিতে৷ হ্যাঁ পরদায় এ চরিত্রের নাম ‘কালিয়া’ হতে পারে, কিন্তু দেশের সিনেমা ইতিহাস জানে, তিনি অমিতাভ বচ্চন ছাড়া আর কেউ নন৷
১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘জঞ্জির’ ছবিতে এক কড়া পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় দেখা যায় তাকে৷ এই ছবির পরেই তাকে বলিউডের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যানে’র তকমা দেন অনেকে৷ সেবছরই জয়া ভাদুরীকে বিয়ে করেন অমিতাভ৷ বিয়ের একমাস পরেই এই নবদম্পতির ছবি ‘অভিমান’ আবার সুপারহিট৷ ‘নমক হারাম’ ছবিতে ফের রাজেশ খান্নার সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেন অমিতাভ৷
১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দিওয়ার’য়ে অভিনয় করে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান৷ এই ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ আজও সকলের মুখে মুখে৷ একই সালে মুক্তি পায় ‘শোলে’৷ এই ছবিটি সেসময়ের ভারতীয় চলচিত্র্র জগতের সবচেয়ে বড় ছবি হয়ে দাঁড়ায়৷ এখনও পর্যন্ত দুই শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন অমিতাভ৷ সংখ্যা এবং সফলতার বিচারে এই পরিসংখ্যান বিশ্বের যে কোনও তারকার কাছেই স্বপ্নের কাছাকাছি।
‘স্টারডম’ রাজেশ খান্নাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে করে দিয়েছিল কি না, কাজের লোকেরা তাঁর সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সন্তুষ্ট না হয়ে অন্য কাউকে খুঁজেছিলেন কি না, সে প্রসঙ্গ গৌণ৷ আসলে ইতিহাস অপেক্ষা করে পালাবদলের৷ স্বাধীনতা আড়াই দশক পেরনো দেশের অন্তরে যে না পাওয়ার অনেক হতাশা জমা হয়েছে, অনেক রাগ ফেটে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে. বদলের প্রবল ইচ্ছে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরের খোলনলচে পালটে দিতে চাইছে তা টের পাচ্ছিল সিনেমা শিল্প৷ রোম্যান্টিকতার বাসরকুঞ্জে সেদিন আক্ষরিকই প্রয়োজন ছিল একজন ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর৷ সিনেমা তাই আশ্রয় খুঁজল এক লম্বা পুরুষের, যিনি সময়ের অ্যাটিটিউড কণ্ঠে নিয়ে বলে উঠতে পারবেন, ‘ম্যায় আজ ভি ফেকে হুয়ে পয়সে নেহি উঠাতে’৷ নাহ শুধু অস্বীকারের ভাষা জোগানোই নয়, তিনিই তো বলতে পারেন, ‘ যাঁহা খাড়ে হো যাতে, লাইন উঁহিসে শুরু হোতি৷
১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে জন্মেছিলেন৷ আর আজ মায়ানগরীর বিখ্যাত ‘প্রতীক্ষা’র মালিক তিনি৷ দীর্ঘ ৭২ বছরের জীবনে অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে তার৷ তবুও মাথা উঁচু করে আজও নিজের জায়গাটা বজায় রেখেছেন৷
২০১৩ সালে হলিউডের ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই’ ছবিতে একটি ছোট্ট ভূমিকায় অভিনেতা লিওনার্দো দ্য কাপ্রিওর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেন বিগ বি৷ শুধু ফিল্ম নয় টেলিভিশনের জগতেও অমিতাভের আসা যাওয়া রয়েছে৷২০০০ সাল থেকে টেলিভিশনের সবচেয়ে সফল টেলিশো ‘কৌন বানেগা ক্রোড়পতি’৷ মাঝে একটি সিজনে শাহরুখ খানকে নিয়ে আসা হলেও ফের আমিতাভকেই হাল ধরতে হয় এই শোটির৷ দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এই শোয়ের একমাত্র ইউএসপি অমিতাভ বচ্চন৷ শুক্রবার থেকে শুরু করেছেন ‘আজ কি রাত হ্যায় জিন্দেগি’ নামের আরেকটি টিভি অনুষ্ঠানের শ্যুটিং। যার প্রিমিয়ার চমক আসছে ১৮ অক্টোবর। অনেকেই ধারণা করছে বিগ বি’র ৭৩তম জন্মদিনের বড় উপহার হয়ে আসেছে এই টিভি শো’টি।
অপেক্ষা তো ছিল এই শুরুরই৷ এই প্রবণতারই৷ এই রুখে দাঁডানোরই৷ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে যে প্রবল প্রতিবাদে একটা দশক গর্জে উঠেছিল, তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে যদি কেউ নির্লিপ্ত হয়ে বলতে পারেন ‘ ডনকো ইন্তেজার তো গ্যারা মুলুককো পুলিশ কররাহা হ্যায়’, তখন তাকে ‘পাকাড়না’ শুধু মুশকিলই নয়, সত্যি ‘না মুমকিন’ হয়ে পড়ে৷ তবে এর মধ্যে প্রেমের ছুটি নয়৷ রোম্যান্টিকতার মেদুর নরম আলোর ভিতরও যাঁর প্রত্যয়ী প্রেম জোরগলায় বলে উঠতে পারবে , ‘ দিওয়ার যো হ্যায় হাম দোনোমে আজ গিরা দো, কিঁউ দিলপে সুলগতে হুয়া লোগোকে বাতা দে, হাঁ হামকো মোহব্বত হ্যায়’৷ যিনি সময়ের হয়ে থাপ্পড় লাগাতে পারেন অন্ধকারের গালে৷ যিনি সাধারণের না আদায় হওয়া দাবীগুলো পরদায় মিটিয়ে দিতে পারেন৷ সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন৷ ওই ছোট ছোট ঘুপচি হলগুলোয়, ভাঙা-আধ ভাঙা চেয়ারে বসা খেটে খাওয়া মানুষগুলোর চোখের সামনে ইতিহাসের ক্যামেরা যখন পা থেকে প্যান করে তাঁর মাথা অবধি পৌঁছয়, তখন যে লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ তৈরি হয়, তা একক আইডেন্টিটির পরিসর ছাপিয়ে পৌঁছে যায় ইতিহাসের অন্দরে৷ প্রজন্মের সেই অ্যাটিটিউড, সেই চাহিদাপূরণের সম্ভার নিয়ে যে ফেরিওয়ালা এভাবে হাজির হন, শুধু অভিনেতার পরিচয়ে তিনি কীভাবে আটকে থাকবেন৷
তিনি তাই হয়ে ওঠেন এক ইতিহাসপুরুষ৷ আঠাত্তরের বন্যার সময়, কেউ কেউ যে ভেবেছিলেন, অমিতাভ বচ্চন একা হতে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারেন, তা কি শুধু একজন অভিনেতা বলে! ‘কুলি’র দুর্ঘটনা তো বটেই, এই সেদিনও তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে কালীঘাটে যে যজ্ঞ হল, সে কি শুধু একজন অভিনেতার জন্য? তাঁর বাড়ির সামনে সপ্তাহের একটা দিন যে গুণগ্রাহীর ভিড় এই এতগুলো বছরেও বিন্দুমাত্র ফিকে হল না, সে শুধু ওই অভিনেতার জন্য হতে পারেন৷ এই এতকানি আবেগ তুলে রাখা সময়ের ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরুষের জন্য, যাঁকে দেখে বিশ্বাস করা যায় যে সময়ের চাকাটি তিনি নিজের হাতে বদলে দিতে পারেন৷ অভিনেতা তো অনেকে হন, নায়ক সকলেই নন৷ আবার নায়ক যাঁরা হন, তাঁদের সকলেই অমিতাভ বচ্চন হতে পারেন না৷
ইতিহাসের কৃপা যিনি পান, তিনি যদি পরিশ্রমী হন, তিনি যদি সাধনার মর্ম বোঝেন, তবে সেই ফলাফলের নাম নিশ্চিতই অমিতাভ বচ্চন৷ ‘জঞ্জির’ থেকে ‘পিকু’ তিনি এমন এক চলমান প্রকল্প সিনে ইতিহাস আজও যার উপর চোখ বুজিয়ে ভরসা করতে পারে৷
জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা৷
১১ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে