বিনোদন ডেস্ক : একটানা হর্নটা বেজেই যাচ্ছিল। মিনিট দশেক ধরে তা থামতে না দেখে গ্রামবাসীরা গিয়ে দেখেন, নয়ানজুলির ভিতর উল্টে পড়ে আছে একটা ইনোভা। দুর্ঘটনার কবলে পড়া আরোহীদের বেশির ভাগই অচৈতন্য। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি, ওই দুর্ঘটনায় উপমহাদেশে প্রখ্যাত লোকগানের শিল্পী কালিকা প্রসাদ ভট্টচার্য মারা গিয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন তার পাঁচ সতীর্থ।
মুহূর্তের মধ্যেই খবরটা সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কালিকাপ্রসাদ আর নেই! মঙ্গলবার সকালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ওই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন তিনি। 'দোহার'-এর বাকি সদস্য নীলাদ্রি রায়, অর্ণব রায়, সন্দীপন পাল, সুদীপ্ত চক্রবর্তী ও রাজীব দাস গুরুতর জখম হয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি।
তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গার হাড় ভাঙার পাশাপাশি মাথায় গুরুতর চোট লেগেছে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, আহতদের মধ্যে তিন জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি।
শেষটা হল জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে। সাতচল্লিশের অকাল প্রয়াণের আগের দিন। পশ্চিমবঙ্গের রাজারহাট-গোপালপুরে কৃষিমেলার এক অনুষ্ঠানে। লোকগানের ভাণ্ডার উপুড় করে উপহার ঢেলে দিয়েছেন শ্রোতাদের। অনুষ্ঠানও শেষ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও গানের অনুরোধ উড়ে এলো কালিকাপ্রসাদের দিকে।
বাউল, ঝুমুর, সারিগান, বিহু, ভাটিয়ালি, চটকা বা ভাওয়াইয়া নয়- জাতীয় সঙ্গীত দিয়েই শেষ হোক অনুষ্ঠান। এমনই প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত এবং রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। আরও এক বার অনুরোধ এলো দোলা সেনের কাছ থেকে। ততক্ষণে মঞ্চ থেকে নেমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে ফেলেছেন কালিকাপ্রসাদ। কিন্তু, সে অনুরোধ ফেরাতে পারলেন না। এ বার দলের সকলকে নিয়ে ফের মঞ্চে পা রাখলেন কালিকা। গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত। সেটাই ছিল কালিকাপ্রসাদের শেষ অনুষ্ঠান।
কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সংস্কৃতি জগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন বিকেলে কালিকাপ্রসাদের দেহ নিয়ে আসা হয় তার সন্তোষপুরের বাড়িতে। পথে নবান্নের সামনে তাকে শ্রদ্ধা জানান মুখ্যমন্ত্রী। বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ তার দেহ রবীন্দ্রসদনে নিয়ে আসা হয়। সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত কালিকাপ্রসাদের দেহ সেখানে রাখা হয়। এ দিন রাতেই তার শেষকৃত্য কেওড়াতলা শ্মশানে।
পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন সকাল ৮টা ৫০ নাগাদ হুগলির গুড়াপের কাছে টিম-দোহারের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি নয়ানজুলির ভিতর উল্টে যায়। সকলকে উদ্ধার করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিত্সকেরা কালিকাপ্রসাদকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
সোমবার সন্ধ্যায় রাজারহাট নিউটাউনে অনুষ্ঠান ছিল দোহারের। সেখানে গান গেয়েছিলেন কালিকাপ্রসাদ। এ দিন বীরভূমের সিউড়িতে তাদের অনুষ্ঠান ছিল। সকাল সাতটা নাগাদ কলকাতা থেকে বেরিয়েছিল টিম-দোহার। পুলিশের দাবি, পথে গুড়াপের কাছে রাস্তার ধারে পুঁতে রাখা লোহার বিমে দোহারের গাড়িটি গিয়ে ধাক্কা মারে। এর পর প্রায় ঘষটাতে ঘষটাতে গাড়িটি ৯০ ফুট মতো এগিয়ে যায়। এর পর রাস্তার ডান দিকে ডিভাইডারের মতো রাখা লোহার পাতে কোনও ভাবে গাড়ির সামনের ডান দিকের চাকার টায়ার ফেঁসে যায়। পরে সেই চাকা খুলে গাড়িটি নয়ানজুলির ভিতর উল্টে যায় বলে পুলিশের দাবি।
আসামের শিলচরে কালিকাপ্রসাদের জন্ম ১৯৭০ সালে। সেখানেই স্কুল-কলেজের পাঠ সেরে কলকাতার যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। ১৯৯৯ সালে গানের দল দোহার গড়ে তোলেন। লোকগানই গাইতেন কালিকাপ্রসাদ। গায়কের আকস্মিক মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করতে পারেনি তার পরিবার এবং দুই বাংলার সংস্কৃতি জগৎ, বাংলাদেশেও শোকের ছায়া নেমে আছে। শোকপ্রকাশ করেছেন দুই বাংলার সাংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পীরা।
০৮ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি