মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০১৭, ১১:২৭:১৫

ভুতুর মাও ছিলেন শিশুশিল্পী, জানালেন শেষদিনের গল্প

 ভুতুর মাও ছিলেন শিশুশিল্পী, জানালেন শেষদিনের গল্প

বিনোদন ডেস্ক: তিন মাস হয়ে গেল, টেলিভিশন থেকে বিদায় নিয়েছে ‘ভুতু’। ইচ্ছে করেই একটা লম্বা ব্রেক নিচ্ছেন ভুতুর মা অর্থাৎ অভিনেত্রী মিমি দত্ত। কিন্তু ভুতুকে বা ভুতুর মা-কে ভুলতে পারেননি দর্শক। তাঁদের মনে ভীষণ ভাবে জীবন্ত এই চরিত্রগুলি।

দর্শকদের মতো ভুতুর মা অর্থাৎ অভিনেত্রী মিমি দত্তও কি মিস করছেন ভুতুকে? এই চরিত্রটা এখনও কতটা ঘিরে আছে তাঁকে, এমন নানাবিধ প্রশ্নচিহ্ন নিয়েই একদিন জমল আড্ডা...  

এখন অবসরে কী করছ? তোমার হবি কী?
মিমি: আমি খুব গান শুনতে পছন্দ করি আর রান্না করতে খুব ভালবাসি। তাছাড়া আমি কাউন্সেলিং করি। এটা আমার পড়াশোনার সাবজেক্ট নয়। কোনও ট্রেনিংও নেই। কিন্তু অনেক ছোট থেকেই পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট আর পাওয়ার থিঙ্কিংয়ের বই পড়তাম।

তখন থেকেই এই বিষয়টা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। আমার মনে হয় যে আমি যদি এমন কিছু করতে পারি যাতে মানুষের উপকার হয়, মানুষকে একটু ভাল রাখতে পারি, তাদের একটু সুস্থ জীবন দিতে পারি, তবে সেটা খুব শান্তির।

চেনা পরিচিত, বা অল্প পরিচিত কেউ কোনও সমস্যা নিয়ে এলে, আমার মতো করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। এছাড়া আমি খুব বেড়াতে ভালবাসি। আমি যে এত কাজ করি, সেটা যেমন এই জন্য যে আমি কাজ করতে ভালবাসি, তাছাড়া আরও একটা কারণে— যাতে প্রচুর বেড়াতে পারি। আমি চাই এগারো মাস কাজ করব আর একটা মাস প্রচুর ঘুরব।

ভুতুকে মিস করছ?
মিমি: প্রচণ্ড। আমাদের কথা হতেই থাকে যদিও। ফোনেও কথা হয়, ওর মায়ের সঙ্গেও হয়। কাকিমা এমনিই ফোন করে আমাকে। আর সময় থাকলেই দেখা করি আমরা।

তুমি তো অভিনয় করছ অনেক দিন হল...
মিমি: হ্যাঁ, তা প্রায় ১৯ বছর। বাই গডস গ্রেস আমি বলব, ৩ বছর বয়স থেকে অভিনয় করে চলেছি। শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করার পরে একটুও গ্যাপ পাইনি। জিৎ-কোয়েলের শুভদৃষ্টি, তার পরে জোর, হাসিখুশি ক্লাব... জিতের সঙ্গে প্রায় পাঁচটা ছবি করেছি। অঞ্জন চৌধুরীর কাছেই আমার এই প্রফেশনে হাতেখড়ি বলা যায়। এখনও ওঁর পরিবারের সকলের সঙ্গে আমার একটা অদ্ভুত বন্ডিং।

উনি হঠাৎই একদিন আমার মাকে বলেছিলেন, ওর দু একটা ছেঁড়া জামাকাপড় নিয়ে চলে আয়। কাল থেকে আমার ছবির শ্যুটিং। তখন আমার ৩ বছর বয়স। কথাও ঠিক করে বলতে পারি না। সেটাই প্রথম কাজ আমার, গুন্ডা ছবিতে। তার পরে স্বপন সাহার দেবী ছবিতে দেবী চরিত্রটা করেছিলাম। খুব পপুলার হয়েছিল ছবিটা।

এর পরে টেলিভিশনেও অনেক কাজ করেছি। জি বাংলা তখনও আসেনি, আলফা বাংলার প্রজেক্টে কাজ করেছি। সবচেয়ে বড় কথা জন্মভূমি করেছি! তবেই ভেবে দেখো আমি কবেকার অভিনেত্রী...! জন্মভূমি করেছিলাম দু বার, দুটো চরিত্রে। অঞ্জন চৌধুরীর মামা-ভাগ্নে-তেও করেছি। সেগুলো সবই শিশুশিল্পী হিসেবে। কিন্তু টেলিভিশনে হিরোইন হিসেবে প্রথম ব্রেক আমার ইটিভি বাংলায় কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি-তে।

স্নেহাশিস চক্রবর্তীর ব্লুজ-এর প্রযোজনা ছিল। ওটা প্রায় সাড়ে চার বছর চলেছিল। কনীনিকাদি মেঘ হতো আর আমি বৃষ্টি হতাম। আমাকে দিয়েই শেষ হয়েছিল ধারাবাহিকটা। যখন শুরু করেছিলাম ক্লাস সেভেনে পড়তাম আর যখন শেষ হয় সিরিয়ালটা, তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে। এখনও শো করতে গেলে মানুষজন ওই চরিত্রটার কথা বলে।

তোমার এই জার্নিটা দারুণ...
মিমি: হ্যাঁ আমি খুব লাকি যে আমি অনেক সিনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি ভারতীদিদার সঙ্গে কাজ করেছি শুভদৃষ্টি ছবিতে। গীতাদিদার সঙ্গেও কাজ করেছি মামা-ভাগ্নে-তে। রঞ্জিত মল্লিক, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দেবশ্রীদি, রচনাদি, রীনাদি মানে অঞ্জন চৌধুরীর ছোট মেয়ে... আমি তখন ওদের আন্টি বলতাম, এখন দিদি বলি।

দিদি নাম্বার ওয়ান-এ যখন যাই, রচনাদি তো আমাকে দেখে খুব আপ্লুত। দেবী-তে একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি কিন্তু রচনাদির তো যেন বয়স বাড়ে না। আমি দিদি বলছি দেখে আমাকে বলেছিল, তুই আমাকে দিদা বল, তোকে আমি এত ছোট দেখেছি!

তুমি সেই জন্যেই কি ভাল ভাবে কানেক্ট করতে পেরেছ ভুতুর সঙ্গে? এই যে একটা অন্য রকম জীবন, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নয়, এত এক্সপোজার এত ছোট বয়সে, এত কঠিন একটা শিডিউলের মধ্যে কাজ করা...

মিমি: আমি একটাই কথা বলব। ভুতু কিন্তু একদম আলাদা একটা বাচ্চা, ও হল একজন গড গিফটেড চাইল্ড। সবারই তো একটা সময় লাগে নতুন কিছু শিখতে। ও এমন একটা বাচ্চা, যার কোনও সময় লাগল না, আলাদা করে কিছু শিখতে লাগল না। যে টেলিভিশনে আসলেই একটা ম্যাজিক হয়ে যায়।

আমি হলাম সেই আর্টিস্ট যে সবথেকে বেশি সময় ধরে ওর সঙ্গে কাজ করেছি আর ওর সঙ্গে আমার একটু বেশি ক্লোজনেস তৈরি হয়েছিল রিয়েল লাইফে। আমাকে ও মা বলে ডাকে জানো তো, এখনও! এরকমও হয়েছে যে শ্যুটিং চলাকালীন ও মা বলে ডাকছে, আমিও এগিয়ে গেছি, কাকিমাও এগিয়ে গেছে। তখন ও কাকিমাকে বলেছে, ‘‘তুমি মা নও, ওই মা-কে ডাকছি বাবা!’’ তার পরে ধরো দুপুরবেলা ওকে ভাত মেখে খাইয়ে দিতাম।

আবার কাছে এসে বলতো, আদর করে দাও। আমি ওকে আদর করব আবার ও আমাকে আদর করবে। অন্য কাউকে আদর করতে দেবে না, একটু পজেসিভও ছিল। আমি আমার বাচ্চার মতোই ওকে ট্রিট করেছি একটা বছর। আমার ছোটবেলাটা ওর মধ্যে দেখেছি। তবে হ্যাঁ, আমার ছোটবেলাটা অনেক বেশি সুন্দর ছিল। এত প্রেশার ছিল না। ওকে দেখে মাঝেমধ্যে খুব কষ্ট হতো। কনস্ট্যান্ট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর যখন পা ব্যথা হতো, রাতের পর রাত ওর পা টিপে দিতাম, ঘুম পাড়িয়ে দিতাম, তখন মনে হতো, এই বাচ্চাটার উপরে বোধহয় অনেক বেশি দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও কাজের বাইরে খুব ইনোসেন্ট কিন্তু কাজ করার সময়ে যেন অন্য মানুষ হয়ে যায় এবং সেটা শেখবার মতো। ওকে দেখে খুব শান্তি পাই আমি। খুব মিষ্টি একটা মানুষ, ও অনেক বড় হোক, এটাই আমি চাই।

তুমি এত কাজ করেছ কিন্তু আমরা সবাই তোমাকে ভুতুর মা বলেই ডাকি, সেটাতে অস্বস্তি হয় না?
মিমি: না, আমার ভাল লাগে। সিরিয়ালটা চলাকালীন তো বটেই, এখনও যখন আমি শো করতে যাই, সবাই কিন্তু আমাকে প্রথমে ভুতুর মা বলেই আইডেন্টিফাই করে, তার পরে বাকি চরিত্রগুলো নিয়ে বলে। এটা আমার ভাল লাগে খুবই কারণ এই চরিত্রটা আমাকে কমপ্লিট করেছে।

আমার জার্নিটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, সব রকম চরিত্র করেছি, দর্শকের কাছে সব রকম ভাবে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করতে পেরেছি, শুধু মা সত্তাটা একমাত্র এই সিরিয়ালটার মধ্যে দিয়েই দর্শক দেখতে পেয়েছে। আর এই সিরিয়ালটা করতে গিয়ে আমাকে কখনও গ্লিসারিন নিতে হয়নি। আমি আসলে অভিনয় করিনি এই চরিত্রটার জন্য। আমার আর ভুতুর সবচেয়ে বেশি সিন থাকত একসঙ্গে।

মা আর বাচ্চার বন্ডিংটা দেখানোর জন্য অনেক সময়েই খুব কষ্টের কিছু সিকোয়েন্স তৈরি করা হতো। আমি শ্যুটিং করতে করতে এত ইমোশনাল হয়ে যেতাম... শেষদিনের শ্যুটিংয়ে যখন আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে... ভুতু বলছে মা আমি এবার চলে যাই... হাপুস নয়নে আমি কাঁদছি, ভুতু কাঁদছে আর পাশ থেকে দেখছি সমস্ত আর্টিস্ট, সমস্ত টেকনিশিয়ানস, ডিরেক্টর সবাই কাঁদছে।

আমাদের দুজনকে সামলানো যাচ্ছিল না। কাট বলে দেওয়ার পরেও আমি বেদিটার উপরে আছড়ে পড়ে কেঁদেছি। আমার মা ফোন করেছে, আমি ঠিক মতো কথা বলতে পারিনি। তাই আমি বলব, এই চরিত্রটা আমার অনেক বেশি কাছের। এই একটা চরিত্র আমার মনে হয়, দর্শকদের মনে সারা জীবন রয়ে যাবে।-এবেলা
এমটিনিউজ২৪/এম.জে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে