বক্স অফিসে সাড়া ফেলেছে 'শুধু তোমারই জন্য'
বিনোদন ডেস্ক : পারিবারিক গল্প। সঙ্গে অতীতের জোড়া রোমান্স। কুশলী হাতে তিনটে আলাদা বুনোটের গল্পকে সামলেছেন বিরসা দাশগুপ্ত। রিমেকেও এনেছেন নিজস্ব টাচ।
•শুধু তোমারই জন্য। পরিচালনা: বিরসা দাশগুপ্ত। অভিনয়ে: দেব, শ্রাবন্তী, মিমি, সোহম, অরিন্দম শীল।
সিনেমার বয়েস এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। তবু আজও প্রেমের ছবির মার নেই। বক্স অফিসে। বিশেষত যদি সিনেমার চিত্রনাট্যে দুটি অর্ধে দুটি আলাদা–আলাদা প্রেম এবং সেই দুই প্রেমের গল্পকে বাঁধার জন্য আবার বাইরে আরও একটা প্রেমের গল্পের আয়োজন থাকে, তবে তো তা একেবারে পুজার ভোজসভার ‘বু্যফে’!
এক টিকিটে তিন–তিনটে প্রেমের গল্প। আলাদা–আলাদা। অথচ একটা আরেকটার সঙ্গে গায়ে–গায়ে জড়িয়ে। সন্দেহ নেই, চিত্রনাট্যের এই রসায়নটাই ‘শুধু তোমারই জন্য’–তে পরিচালক বিরসা দাশগুপ্তের পক্ষে সবচেয়ে বড় তুরুপের তাস। বিরসা অবশ্য এ ‘প্যাকেজিং’–এর মোড়কটায় একটা নিজস্ব ‘ইমপুট’ও রেখেছেন। তা হল এ ছবির লোকেশন। মূল দুটি প্রেমের গল্পের মধ্যে দৃশ্যগতভাবে দুটি আলাদা ‘টেক্সচার’ বুনে নিতে পেরেছেন বিরসা। প্রথম গল্পটিকে অর্থাৎ সিরাজ আর নয়নতারার প্রেমকে তিনি নিয়ে গেছেন দার্জিলিঙের লোকেশনে।
এ ছবিতে ক্যামেরা–গুণে দার্জিলিংকে দেখতে লেগেছে প্রায় সুইৎজারল্যান্ডের মতো। কুয়াশা, নির্জন গির্জা, টয় ট্রেন, খাদের কোল, ‘কেভেনটারস’–এর ছাদ— সব মিলিয়ে এ ছবি অলস ভাবালু একই সঙ্গে মন ভাল এবং খারাপ করা এমন এক ‘স্পেস’ পেয়ে গেছে, যা দৃশ্যগত ‘মাউন্টিং’–এ বড় বাজেটের হিন্দি ছবির সঙ্গে তুলনীয়। বিরসা সঠিকভাবেই বুঝেছেন বাণিজ্যিক ছবিতে দর্শকের মনকে মুঠোয় পুরতে হলে তাকে চোখের আরাম দিতে হয়। এ ছবিতে সে আয়োজন আক্ষরিক অর্থেই পিকচার পারফেক্ট। সঙ্গে কানের দাবিও মিটিয়েছে মিষ্টি সুরের গান।
এ ছবি এমনিতে বক্স অফিসে দুরন্ত সাফল্য পাওয়া তেলুগু ছবি ‘রাজা–রানী’র রিমেক। বাকিটুকু এ ধরনের রিমেকের ফর্মুলা মেনে এক। কিন্তু সিরাজ আর নয়নতারার কলেজ–প্রেমের এই অংশটায় অর্থাৎ ছবির প্রথমার্ধে ঘটনাগত ও দৃশ্যগত কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েছেন বিরসা। সেটুকুতেই তাঁর সক্ষমতা। সেটুকুতেই তাঁর সাফল্য।
এতদ্দ্বারা পরের ছবিতে বিরসা কি অনেকটা সাহসী আর পুরোটা স্বাধীন হতে পারেন না? সে প্রত্যাশা কিন্তু তিনি নিজেই জাগালেন।
ছবির শুরু অবশ্য প্রেম দিয়ে নয়, বরং অপ্রেম দিয়ে। চিত্রনাট্যের সূচনা আদি (দেব) আর নয়নতারার (শ্রাবন্তী) বিয়ে দিয়ে। দাম্পত্যে প্রবল অসুখী দুজনেই। একসময় এই অশান্তির মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ে নয়নতারা। আদি প্রবল মাতাল অবস্থাতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর এখান থেকেই প্রথম শুরু হয় দুজনের মধ্যে কথা বিনিময়।
আদিকে নয়নতারা শোনায় তার প্রাক্তন প্রেমিকের গল্প। যে প্রেমের শেষ বিচ্ছেদে। সিরাজ (সোহম) ছিল তার কলেজ– সহপাঠী। এক সময়, দুজনে বিয়ে করবে বলে স্থির করে। কিন্তু সিরাজের বাবার (সুপ্রিয় দত্ত) আপত্তিতে এবং একটি দুর্ঘটনায় সে–বিয়ে হয় না। এই পর্বে দার্জিলিঙের লোকেশনের বাইরে আর যা ভারী আকর্ষণীয় লাগে, তা হল নয়নতারার বাবার সদাহাস্যময় উপস্থিতি। বন্ধুর মতো সাবলীল আর রসিক এই বাবার চরিত্রটি খুবই চমৎকারভাবে পর্দায় রূপ দিয়েছেন অরিন্দম শীল। এই ঘটনা জানার পরে নয়ন সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় আদি।
অন্যদিকে আদিকে যাতে নয়ন নিছকই এক মাতাল বা নিষ্ঠুর মানুষ বলে ভেবে না চলে, তাই আদির জীবনের অতীত বৃত্তান্ত একদিন নয়নকে শোনায় বন্ধু চন্দন (বিশ্বনাথ বসু)। সেখানেও আছে একটি প্রেমের ‘ফ্ল্যাশব্যাক’। আদির সঙ্গে পাড়ারই মেয়ে কলির (মিমি চক্রবর্তী) প্রেম। যার সেতু ছিল চন্দন আর তার মজাদার ব্যবসায়ী মামা কংসবাবু (খরাজ মুখোপাধ্যায়)। সিরাজ–নয়নের অতীত প্রেম যেভাবে বিষণ্ণতায় মুড়ে পর্দায় এসেছিল, আদি–কলির প্রেম পর্দায় আসে ঠিক বিপরীতভাবে, খুনসুটি, কমেডি আর বাইকে চেপে ‘রোড হপিং’–এর মধ্যে দিয়ে।
অভিনয়ের দিক দিয়ে শ্রাবন্তী আর মিমি ঠিক বিপরীত। শ্রাবন্তীর ‘গুড গার্ল’ ইমেজকে বা সংলাপ বলার শান্ত ধরনকে যেভাবে চিত্রনাট্যে কাজে লাগানো হয়, ঠিক তেমনই মিমির কাটা কাটা ভঙ্গিতে কথা বলা, ঈষৎ ‘টমবয়িস’ মেজাজকে অভিব্যক্তিতে ধরা— এগুলো ছবিতে খুব সুন্দর কাজে লাগানো হয়েছে। সঙ্গে ভাল কাজে লেগেছে শহরের গলিঘুঁজি— দার্জিলিং–দৃশ্যের ঠিক বিপরীত ছকে। পর্দায় সত্যিই মনে হয়েছে দুটি অর্ধে আলাদা দুটি সিনেমা দেখছি। এই কনট্রাস্টটাই বোধহয় এ ছবির সবচেয়ে বড় জোর। অবশ্য আদি–কলির প্রেমও বিয়োগান্তক হয়। এবার আদি–নয়নের অনিবার্য মিলন— এমনটা যখন দর্শক ভাবছেন, তখনই আসে এ ছবির তৃতীয় অপ্রত্যাশিত মোচড়টি। সেটা বলে দেওয়া অন্যায় হবে।
বেশ কিছুদিন বক্স–অফিসে খরা চলার পরে এ ছবি নিশ্চিতই দেবে–র পায়ের তলায় আবার শক্ত জমি এনে দেবে। বুনো হাঁস–এর পরে কোনও পারিবারিক ছবিতে দেবকে আবার এতটা পাশের বাড়ির ছেলের মতো স্নিগ্ধ লাগল। তিনি এবার ইমেজ বদলানোর কথা ভাবতে পারেন। সোহম বরাবরই রোমান্টিক চরিত্রের চরিত্রায়ণে নিজের অভিনয়ে বেশ খানিকটা ‘কমেডি–এলিমেন্ট’ মিশিয়ে নেন, এবারও তা করেছেন এবং বাকি তিনজনের তুলনায় চিত্রনাট্যের কম সহায়তাকে অতিক্রম করেছেন।
২৮ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস