অ্যাড. এমদাদুল হক লাল, আদালত প্রতিবেদক : জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নায়ক প্রয়াত চৌধুরী মোহাম্মাদ ইমন ওরফে সালমান শাহ (২৫) হত্যা মামলায় র্যাবের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন দায়ের করায় থেমে যায় তদন্ত কার্যক্রম।
আগামী ২৯ অক্টোবর মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলাটির শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে।
মঙ্গলবার ধার্য তারিখে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের সামনে সালমান শাহ স্মৃতি সংসদের বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচিতে দাঁড়িয়ে পিপির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী।
সালমান শাহ হত্যা মামলায় তদন্তের বিরুদ্ধে রিভিশন দায়ের করায় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবুর বিরুদ্ধে আসামিদের পক্ষাবলম্বনের গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন নিহতের মা নীলা চৌধুরী। রিভিশন শুনানির দিনও সালমান শাহ স্মৃতি সংসদের সদস্যরা আদালতে অবস্থান কর্মসূচি পালনের আগাম ঘোষণা দিয়েছেন।
বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচির সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, রাষ্ট্র আমার বিপক্ষে কেন গেল, এটা আমার আসল প্রশ্ন। আমি অবাক হয়েছি রাষ্ট্রপক্ষের পিপি কোন কারণে কত টাকা খেয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় ওনারটা করে নিয়েছে।
নীলা চৌধুরীর বক্তব্য, তার সামনেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবুকে তার কাজের বিষয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ফাইল নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
তার মতে, তিনি মামলার বাদী তিনি না থাকলে তার স্বামী এবং তার স্বামী না থাকলে ভক্তদের কেউ বাদী হয়ে এ মামলা চালাবেন। পিপি আমাদের স্বার্থ দেখবেন এটাই নিয়ম। কিন্ত তিনি তা না করে যা করলেন তা আসামিদের স্বার্থ রক্ষা বৈ অন্য আর কিছু নয়। এজন্য পিপিকে একদিন জবাবদিহি করতে হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নীলা চৌধুরী জানান, রিভিশন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত র্যাব তদন্ত করতে পারছে না। আগামী ২৯ অক্টোম্বর বিভিশন মামলার শুনানি হবে। বাদী হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ বাদীর পক্ষেই থাকবে। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রপক্ষ আমার বিপক্ষে গিয়ে রিভিশন মামলা করেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু হত্যাকারীদের পক্ষ নিয়ে রিভিশন মামলা করেছেন।
এ ব্যাপারে মহানগর পিপি আবু আব্দুল্লার সঙ্গে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, তিনি আইন মেনেই যা করার করেছেন। রিভিশন শুনানিতে আদালতের সিদ্ধান্তেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
মামলাটিতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মামলার বাদী সালমান শাহ’র মা নিলুফার চৌধুরী ওরফে নিলা চৌধুরীর নারাজি গ্রহণ করে র্যাবকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বাদী সালমান শাহ’র মা নিলুফার চৌধুরী মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদালতে হাজির হয়ে নারাজি দাখিলের জন্য সময় প্রার্থনা করেন।
প্রায় ১৫ বছর ধরে চলা মামলাটিতে আদালত সালমান শাহ’র বাবা কমর উদ্দিন ও মা নিলুফার চৌধুরীসহ ৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন। এরপর গত ৮ ডিসেম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালত।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহ’র ১১/বি নিউ ইস্কাটন রোর্ডের ইস্কাটন প্লাজার বাসার নিজ কক্ষে তাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে প্রথমে হলি ফ্যামেলি পরে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ নিয়ে সালমান শাহ’র বাবা একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। ওই মামলা প্রথমে রমনা থানা পুলিশ পরে ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির তদন্ত করেন। তদন্তকালে সালমান শাহ’র লাশ প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ময়নাতদন্ত করা হয়।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে, সালমান শাহ’র মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। পরে সালমান শাহ’র পরিবার ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আপত্তি দিলে সালমানের লাশ কবর থেকে তুলে ফের ময়নাতদন্ত করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিবেদনে লাশ অত্যাধিক পঁচে যাওয়ার কারণে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়।
ময়নাতদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির আত্মহত্যাজনিত কারণে সালমান শাহ’র মৃত্যু হয়েছে মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ওই প্রতিদেনের বিরুদ্ধে বাদী পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে নারাজি দেন। নারাজিতে তিনি সালমান শাহ'র স্ত্রী সামিরা হক, জনৈক আবুল হোসেন খান, বাসার কাজের মেয়ে ডলি, মনেয়ারা বেগম, নিরাপত্তাকর্মী আব্দুল খালেক, সামিরার আত্মীয় রুবি, এফডিসির সহকারী নিত্য পরিচালক নজরুল শেখ ও ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত মর্মে উল্লেখ করেন।
নারাজির পর আদালত ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মজিবুর রহমানের কাছে তদন্তভার হস্তান্তর করা হয়। এ তদন্ত কর্মকর্তাও অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ার একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই সালমানের বাবার ডিওএইচএসের (জোয়ার সাহারা) বাসায় রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ নামের যুবকের আগমন ঘটে।
মিথ্যা পরিচয়ে ওই যুবকের বাসায় প্রবেশের অভিযোগে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় রেজভীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি সালমান শাহ হত্যার কথা স্বীকার করে তার সহযোগী হিসেবে ডন, ডেভিড, ফারুক, আজিজ মোহাম্মাদ ভাই, সাত্তার, সাজু, সালমান শাহের স্ত্রী সামিরা, সামিরার মা লতিফা হক লুসি ও জনৈক রুবির নাম প্রকাশ করে।
পরে ১৯৯৭ সালের ২২ জুলাই আদালতের তার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা হয়।
অতঃপর বাদী সালমানের বাবা কমর উদ্দিন অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করেন।
আদালত ১৯৯৭ সালের ২৭ জুলাই অপমৃত্যুর মামলা এবং ক্যান্টনমেন্ট থানার মামলা একত্রে তদন্তের জন্য সিআইডির ওপর তদন্তভার হস্তান্তর করেন। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার খালেকুজ্জামান প্রায় সাড়ে ৩ মাস তদন্তের পর ১৯৯৭ সালের ২ নভেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ওই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, বাদীপক্ষ মামলাটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করলেও এবং জনৈক রেজভী হত্যাকাণ্ডে নিজে জড়িত এবং অন্যদের জড়িত থাকার বিষয়ে নাম প্রকাশ করলেও পরে জেলখানায় রেজভীকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, এ হত্যার বিষয়ে সে কিছুই জানে না।
এতে প্রমাণিত হয় যে, তার স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছা প্রদত্ত ছিল না। মূলত সালমান শাহ’র সঙ্গে নায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার কারণে তার স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহের সূচনা হয়। দাম্পত্য কলহের কারণেই সে আত্মহত্যা করেছে, যা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সমর্থন করে।
আদালতে প্রতিবেদন দাখিল হওয়ার পর ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ফের নারাজি দাখিল করা হয়। যার ভিত্তিতে আদালত ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম